আকিব হাসান সাদ
যে সমস্ত জৈব রাসায়নিক ( Bio-Chemical ) উপাদান মানুষের অপরাধমূলক আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে বিবেচনা করা হয়,মানবদেহে হরমোনের অস্বাভাবিক নিঃসরণ তন্মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অপরাধবিজ্ঞানীরা অপরাধী ও নিরপরাধীদের মধ্যকার হরমোনগত পার্থক্য পর্যবেক্ষন করে এবং অপরাধীদের শরীরে বিশেষ কয়েকটি হরমোনের অস্বাভাবিক ক্ষরণ লক্ষ্য করেছেন। এ থেকে অপরাধবিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে,কতগুলো হরমোনের আধিক্য বা অপর্যাপ্ত ক্ষরণ একজন ব্যক্তির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
মূলত হরমোন হচ্ছে জৈব – রাসায়নিক তরল পদার্থ যা অতি অল্পমাত্রায় প্রানীদেহের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমুহ ( Endocrine Glands ) থেকে নিঃসৃত হয়ে রক্তের সাহায্যে দেহের বিভিন্ন অংগে ছড়িয়ে পড়ে।
সাধারণত হরমোন শব্দের অর্থ হচ্ছে ” আমি উত্তেজিত করি “। হরমোন কে বলা হয় Chemical Messenger বা রাসায়নিক বার্তাবাহক যা দেহের স্বাভাবিক ও সুসংহত বৃদ্ধি, জনন এবং বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে।
হরমোন একটি নির্দিষ্ট অথচ সল্পমাত্রায় নিঃসৃত হয়। নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত বা কম নিঃসরণে স্বাভাবিক বিক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে এবং শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। অপরাধবিজ্ঞানে গ্রন্থি ( Gland ) সংক্রান্ত অধ্যয়নের দার উন্মোচিত হয় ” Schlapp ও Smith ” এর ” The New Criminology ” বইটি প্রকাশের পর।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে,নিরপরাধীদের তুলনায় অপরাধীদের ক্ষেত্রে গ্রন্থিগত সমস্যা ( Glandular Disorder ) দুই থেকে তিনগুন বেশি।
যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রন্থিগত সমস্যার সাথে অপরাধমূলক আচরণের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে হাইপারথাইরয়ডিজম ( Hyperthyroidism ) এবং কুশিং ( Cushing ) ব্যাধির সাথে অপরাধমূলক আচরণের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
হাইপারথাইরয়ডিজম ( Hyperthyroidism ) মানুষের ব্যক্তিত্বকে পরিবর্তন করে দেয়,আর কুশিং ( Cushing ) রোগ অস্বাভাবিক বাধ্যকরী ও মোহগ্রস্ত আচরণকে প্রকাশ করে। কিন্তু এতে মজার বিষয় হলো এ রোগ দুটি বিশেষত মেয়েদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
অপরাধবিজ্ঞানীদের কাছে টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” এবং ” Adrenal ” গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অন্যান্য ” Androgen ” হরমোনগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কিছু পরীক্ষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” হরমোনের সাথে আক্রমণাত্মক আচরণের সম্পর্ক রয়েছে।
টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” কে বলা হয় পুরুষালী হরমোন। একজন মহিলার শরীরে এই হরমোনের উপস্থিতি একজন পুরুষের দশভাগের এক ভাগ মাত্র। যদিও পুরুষালী হরমোনের ( Testosterone ) সাথে Aggressive এবং মেয়েলী হরমোনের সাথে Non-aggressive এর সম্পর্ক করাটা বিভ্রান্তিকর, তবে শরীরে পুরুষালী হরমোন বা টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” এর অস্বাভাবিকতার মাত্রা যে হরমোনমূলক আচরণকে তরান্বিত করে তার প্রমাণ রয়েছে।
অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে _ হিংসাত্মক ( Violent ) অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দেহে টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা নারী প্রানীর শরীরে পুরুষালী হরমোন প্রয়োগ করে Aggressive আচরণ এবং পুরুষ প্রাণীর শরীরে মেয়েলী হরমোন প্রয়োগ করে বিপরীত আচরণ লক্ষ্য করেছেন।
বয়ঃসন্ধিকালের মধ্যবর্তী ( Mid Teen ) পর্যায়ে, পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” হরমোনের আধিক্য দেখা যায় এবং ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা কমতে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর পরই এই হরমোনের উপস্থিতি অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। এছাড়া বছরের নভেম্বর – ডিসেম্বর মাসে এই হরমোনের আধিক্য থাকে।
টেস্টোস্টেরন ” Testosterone ” এর মাত্রা বৃদ্ধি ব্যক্তির সামাজিকতা বোধকে হ্রাস করে ফেলে। এমনকি তাকে একাকী থাকার প্রতি আগ্রহী করে তোলে এবং সামাজিক বিধি-বিধান মান্য করা থেকে বিচ্যুত করে বলে বিবেচনা করা হয়।
গর্ভ ও প্রসবকালীন সময়ে মায়ের শরীরে Androgen এর মাত্রা বৃদ্ধি গর্ভস্থিত বাচ্চার আচরণে আগ্রাসন বা Aggression এর প্রভাবের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এনেসথেসিয়া ” Anesthesia ” বা সহজে সন্তান প্রসবের জন্য যেসব ঔষধ মায়েদের সেবন করানো হয়,ঐসব ঔষধে Androgen এর উপাদান বিদ্যমান থাকে।
কিছু কিছু গবেষণায় মহিলাদের প্রাক ঋতুস্রাবকালীন লক্ষণকে ( Premenstrual Syndrome ) তাদের দ্বারা কৃত অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে পরিলক্ষিত হয়েছে এবং তাদের ঋতুস্রাবকালীন সময় এবং প্রাক ঋতুস্রাবকালীন সময়কে তাদের Aggressive আচরণ ও আত্নহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
Katherine Delton ১৫৬ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা কয়েদিদের উপর এমন গবেষণা করে দেখেছেন যে,ঐসব অপরাধীরা তাদের ৪৯% অপরাধ এই সময়ের মধ্যে করেছিলেন।
Discussion about this post