লেখকঃ অ্যাড.এম.মাফতুন আহমেদ
কোনটা রেখে কোনটা লিখবো ভেবে কূল পায় না। নানা পেশায় নিমগ্ন। অতঃপর উঁনপাজুরে জীবন। তবুও সময় করে কিছু না লিখলে কেউ না কেউ লিখবেন;কিছু বলবেন। বিস্মৃতিতে চলে যাবার কথা নয়। দূর অতীত ও নয়। সেদিনের কথা।
একবার এক দুর্নীতিপরায়ন পেশকারের বিরুদ্ধে কলম উঁচু করতে যেয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নায়ক উইনষ্টন চার্চিল-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আমার সম্পাদনায় “আজাদ” পত্রিকায় লিখেছিলাম-“ I am alone in the world, fighting for humanity, for the liberation of the people.” অর্থাৎ-‘আমি পৃথিবীতে একা,লড়ছি মানবতার পক্ষে,জনতার মুক্তির জন্য’।
আমার প্রতি আস্থা রেখে শতাধিক আইনজীবী দুর্নীতি পরায়ণ পেশকারের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জ্ঞাত করেছিলেন। অতঃপর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধোঁয়া তুলে অনেকে “পেশকার মহাশয় ‘ একজন ভাল লোক,এই মর্মে লিখিতভাবে সেই ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে পুনরায় তসরিফ আনলেন।

তাহলে কোথায় থাকলো নীতি,নৈতিকতা বন্ধুবর বিজ্ঞ আইনজীবীদের? আমরা কী ধরে নিতে পারি না এরা পিয়ন-পেশকারের বশংবদ তথাকথিত হাতে গোনা বিজ্ঞ আইনজীবীরা। মূখ্যত আলোচনায় ফিরে আসি।
খুলনা থেকে ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে মন্তব্য করেছেন স্নেহাষ্পদ অ্যাড.মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন-“আইন পেশার জন্য একটি অশনি সংকেত”এই শিরোনামে। তিনি একজন বিদগ্ধ আইনজীবী হিসেবে তাঁর হৃদয়গ্রাহী মনের একরাশ আকুতি তার ফেসবুক আইডিতে তুলে ধরেছেন। লেখার মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন,যা হুবহু তুলে ধরা হলো।
….“এখন সময় বদলেছে-আইনজীবীদের “আইনজীবী সহকারী”!! যারা কিনা আমাদের কেরানি কিংবা মহুরি তাদের কার্যক্রম নিয়ে সবাই আমরা কমবেশী জানি। কিন্তু নিশ্চুপ! আইনজীবী সহকারীরা এখন মামলার মালিক হয়ে নিজেরাই চেম্বার করছেন,মামলা রিসিভ করছেন টাকা পয়সা লেনদেন করছেন , অথচ আমরা সিনিয়র জুনিয়র আইনজীবীগণ তাদের(?) দু’পয়সার উকিল বনে যাচ্ছি।
আইনজীবী সহকারীরাই এখন আইন পেশার জন্য বিষফোঁড়া-একটি অশনিসংকেত। বার কাউন্সিল এসব জানেন নিশ্চয়ই! জেলা আইনজীবী সমিতি গুলো অষ্টমশ্রেণী পাশ করা এই কেরাণি গুলোকেই কি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সিনিয়র আইনজীবী বানিয়ে যাচ্ছেন?? হায়রে আইন পেশা! হায়রে আইন মন্ত্রক! হায়রে বার কাউন্সিল! হায়রা বিচার বিভাগ! হায়রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা! হায়রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা! হায়রে আগামী প্রজন্ম”!
আমি ধন্যবাদ দিয়ে মিঃ অ্যাড.মুজাহিদকে ছোট করতে চাই না। তবে তাঁর সব কথার সাথে আমি বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একমত নই। প্রথমেই নিবেদন করবো কেইথ ইভান্স এর লেখা- “Common Sense Rules of Advocacy” “কমনসেন্স রূলস অ্যব অ্যাডভোকেসি” গ্রন্থটি সবাইকে একবার চোখ বুলিয়ে নেবার জন্য সবিনয় অনুরোধ।
আইনপেশা কী? কোথায় যাচ্ছে এই মহান পেশা সবিস্তারে জানা যাবে;এই বিদেশী বইটিতে। কে না জানে আইনপেশা একটি গবেষণাধর্মী মহৎ পেশা। অভিজাত ও সম্মানজনক পেশা। একজন দক্ষ আইনজীবী হবার জন্য দরকার আইন চর্চার পাশাপাশি নৈতিকতা,সততা,একাগ্রতা,যুক্তিপরায়ণতা,লেখার জন্য নিপুনতা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ।
সন্দেহ নেই, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আর নানা অনিয়ম ছেয়ে গেছে। ‘মোহরা’ ফার্সি শব্দ। জাতে উঠতে যেয়ে এরা সেজেছেন ‘আইনজীবী সহকারী’। লেখাপড়া! গকুলের ষাড়। তবে সাজতে যান বড় বুদ্ধিজীবী! কারণ যে বউ সংসারে আয় করে দেয় তাকে তো একটু স্যালুট করতে হয়।
সন্দেহ নেই,আমি বটতলার একজন উকিল। তবুও আমার প্রশ্ন, কেন মোহরাররা বিষফোঁড়া হবেন? নিজে ভাল হলে জগত ভালো। নিজে পেশায় মনোনিবেশ হলে মক্কেল আইনজীবীকে খুঁজে নেবে। অর্থের পেছনে না ছুটে যোগ্যতা থাকলে অর্থ চাকার মতো পন পন করে চারপাশে ঘুরবে। বিকাশে কাউকে কমিশন দেয়া লাগবে না।
মোহরার,পেশকারদের তেলেসমতি কারবার অনেক পুরাতন কাহিনী। (বঙ্কিমের ‘গুড়েরাম মুচি পেশকার’ বইটিতে এতসব লেখা আছে) কতজন আইনজীবী এখন পড়াশুনায় অভ্যস্ত? হাতে গোনা শতকরা ৫ জন? কতজন আইনজীবী বিনা পূজিতে খালি পকেটে কোর্ট আঙ্গিনায় এসে ধান্ধায় মত্ত থাকে। সংখ্যয় পাল্লায় ভারী।
কতজন বিজ্ঞ মোহরার উপর নির্ভরশীল? কেস প্রতি কত কমিশন মোহরার,দালালদের বিকাশে বা সরাসরি দিতে হয়? অধিকাংশ আইনজীবী পেশকারদের সরাসরি ঘুষ দেয়,পুলিশকে স্যার,বস বলে কোকিলী কণ্ঠে ডাকে।
মোহরা সমিতিতে বিজ্ঞ সাহেবরা বসতে পারেন কিনা? বসলে তাকে আপনি উকিল না মোহরার বললেন? একটি জামিনের জন্য আদালতে কতবার দয়া করেন, হুজুর,স্যার ….. স্যার শব্দ উচ্চারিত হয়। এমনও শুনেছি জামিনের জন্য অনেকে ‘আলহামদু’ সূরা পাঠে দিনভর অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব কী বিজ্ঞতার লক্ষণ? কোন জ্ঞানী,গুণির কাজ?
এসবের জন্য দায়ি কে? মোহরার না বিজ্ঞ আইনজীবী। তবে এসব কর্মে সবাই যে জড়িত সেটা বলা যাবে না। ধরে নিতে পারেন তাদের সংখ্য অতি স্বল্প। আগেই বলেছি আইন পেশা একটি অভিজাত ও সম্মানজনক পেশা।
এক বিচারক একবার বলেছিলেন- ““A lawyer has to wear suitable clothes. Clothing is very important.” অর্থাৎ-“একজন আইনজীবীতে মানানসই পোষাক পরিধান করতে হবে”। পোশাক অতি গুরুত্বপূর্ণ। ক’জন ড্রেসকোর্ড মান্য করেন? আমাদের চলনে-বচনে,পোষাকে-আমাদের দেখে কী মনে হয়? মনে হয় কী এটা লর্ড পরিবারের পেশা?
বিংশ শতাব্দীর এমন অনেক উক্তি আছে,মাত্র তিনটি উক্তি উদ্ধৃতি করছি। উইল রর্গাসের বলেন-A person’s lack of policy-consciousness enables him to become a lawyer. অর্থাৎ “কোন ব্যক্তির নীতি-চেতনার অভাব তাকে আইনজীবী হওয়ার জন্য সক্ষম করে তোলে”।

জন সিমনের ভাষায়-People treat a lawyer as an unprincipled, despicable person who engages himself in distorting the truth in a completely scandalous way for a huge amount of money. He can be called a hypocrite.” অর্থাৎ“জনগণ একজন আইনজীবীকে নীতিহীন জঘন্য নীচ ব্যক্তি মনে করেন, যিনি খুব বেশি পরিমান অর্থ লাভের জন্য সম্পূর্ণ কলঙ্ক উপায়ে সত্যের বিকৃতিতে নিজেকে অবিরত নিয়োজিত রাখেন। তাকে ভণ্ড বলা যেতে পারে”।
১৯৫৮ সালের কথা। আইউব খাঁন পূর্ব পাকিস্তানে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে আসছিলেন। গেলেন পুরানো ঢাকার জংসন রোড়ে অবস্থিত জজকোর্টে। সম্পূর্ণ একাকী মনে ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে বিচার উপভোগ করতে। দেখলেন উকিল সাহেব বাদীকে মিথ্যা কথাগুলো সাজিয়ে বলে দিচ্ছেন। মিঃ আইয়ুব তাঁর আত্নজীবনী গ্রন্থ “প্রভু নয় বন্ধু বইয়ে লিখলেন-“কিভাবে আইনের ফাঁক ফোকর সৃস্টি করে মিথ্যা কথা বলতে হয় আমি শিখিয়ে দিতাম। দুর্ভাগ্য! আমার গদি টলমল।
আমাদের দেশে সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি সমান নয়। সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক অবক্ষয় নেমে আসে। শুধু রাষ্ট নয়,কেউ কাউকে কিছু শিখাতে পারে না। নিজেকে শিখতে হয়। আপন ভাল হলে জগত ভাল। আগে নিজেকে চিনতে হবে। আমি কে? আত্নসম্মান, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা একদিনে গড়ে উঠে না।
এখন শিক্ষানবীশ সে ও উকিল! ওকালতি পাশ করে কোন সিনিয়র লাগে না;বই পড়া লাগে না। মোহরার,দালাল আর মোসাহেবী এই হলো মোক্ষম তাবিজ। সেক্ষেত্রে মোহরার যে একদিন সিনিয়র হবেন না এ নিশ্চয়তা কে দেবেন?
লেখকঃ অ্যাড.এম.মাফতুন আহমেদ,জজ কোর্ট,খুলনা
Discussion about this post