মিজানুর রহমান খানঃ
সুপ্রিম কোর্ট সংস্কারের পথে একটা বিরাট অগ্রগতি দেখিয়েছেন। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা পুরোনো—তোমার পতাকা যারে দাও/ তারে বহিবারে দাও শকতি। দেড় শ বছর আগে যে আইন দিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে হাইকোর্ট যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই আইন (হাইকোর্ট রুলস) গত ২২ ফেব্রুয়ারিতে বদলে গেল। মাঝখানে ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চারটা দশক পেরিয়ে গেল। তবু দীর্ঘকালের একটা দাবি পূরণ হলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণ এ থেকে কি সুফল পাবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, হাইকোর্ট আইন মানবে কি না। মানাবে কি না, না মানলে তার প্রতিকার কী হবে।
সময়ের আলোচিত বিষয় আদালত অবমাননা। নতুন বিধিতে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে সুয়োমোটো কিংবা স্বপ্রণোদিত রুল দেওয়া নিয়ে একটা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে দোষণীয় কিছু প্রকাশিত হলে হাইকোর্ট আর তাৎক্ষণিক রুল জারি করবেন না। পত্রিকা হলে তার প্রকাশক, সম্পাদক ও রিপোর্টারের কাছে নোটিশ পাঠাবেন। এর মাধ্যমে তারা প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। এতকাল হাইকোর্টের সুয়োমোটো রুলগুলো কার্যত সংবিধানের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করছিল। কারণ, সংবিধান বলেছে হাইকোর্ট শুধু কোনো আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করবেন। কিন্তু হাইকোর্ট আবেদন ছাড়াই রুল জারি করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
সংসদের মতো সুপ্রিম কোর্ট এবার তিনটি স্থায়ী কমিটি সৃষ্টি করেছেন। একটি কমিটি হাইকোর্টের মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি তদারক করবে। আরেকটি কমিটি অধস্তন আদালতের ব্যবস্থাপনা দেখবে। আরেকটি কমিটি হাইকোর্টের চালু করা রুলস বাস্তবায়ন তদারক করবে।
সুপ্রিম কোর্টে প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞের একটি বড় বিষয় হচ্ছে মোশন। মোশন পিটিশনগুলোতে জরুরি বিষয়ে জরুরি প্রতিকার প্রার্থনা করা হয়। তবে এর শুনানি অনুষ্ঠানে বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। পরিচিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকে বেশি সুযোগ পেতেন। অনেক কনিষ্ঠ তা দেখে ব্যথিত হতেন। এবার ক্রমিক নম্বর অনুসরণের দাওয়াই এসেছে। নির্দিষ্ট বিচারিক আদেশ ছাড়া ক্রমিক অদলবদল করা যাবে না। এই ক্রমিক ওপর-নিচ করা নিয়ে কেরানিরা বাণিজ্য করতেন বলে অভিযোগ আছে। অনেক আইনজীবী রিট পিটিশন দাখিল করেই একটা অন্যায্য ফায়দা নিতেন। রিট দাখিল করেই আইনজীবী সনদ দিতেন যে মামলা বিচারাধীন। এতে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হন। নিম্ন আদালতও বিভ্রান্ত হন। এরপর শুনানি না করে রিট আবেদন তুলে নিতেন। এখন নিয়ম করা হয়েছে আবেদন একবার দায়ের করলে শুনানি ছাড়া তা ফেরত নেওয়া যাবে না। যেসব মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হবে, তা আগেই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
আগে কোনো জামিনের দরখাস্ত এক বেঞ্চে নাকচ হলে সে তথ্য গোপন করে অনেক আইনজীবী অন্য বেঞ্চে তা দাখিল করতেন। এখন নিয়ম করা হয়েছে, একই বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে নতুন করে দরখাস্ত করলে আগের ফলাফল অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। এ ধরনের বহু বিষয় আছে যা নিয়ে উচ্চ আদালতে ভয়ানক অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। দুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট লাইব্রেরিতে আলাপকালে কয়েকজন আইনজীবী অবশ্য বললেন, আইন করা এক জিনিস আর তা বাস্তবায়ন এ দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
অধস্তন আদালতের চলতি প্রশাসনিক কাঠামো যথারীতি লেজেগোবরে অবস্থায় আছে। শাসক দল এভাবে রেখেই তার মেয়াদ পার করল। কেউ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে সাহসই পায়নি।
অন্ধ থেকে প্রলয় বন্ধ রাখার নীতি চলছে। তাই এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, হাইকোর্টের নতুন আইনে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিএ কমিটির কার্যক্রম দক্ষতর করে তোলা হয়নি। এমনকি বিস্ময়করভাবে রুলস সংশোধন কমিটি সংবিধানের ১১৬, ১০৯ অনুচ্ছেদ, মাসদার হোসেন ও কাজি হাবিবুল আউয়ালের মামলার রায়ের নির্দেশনা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্টের অনধিক চার বিচারপতি নিয়ে জিএ কমিটি গঠিত। বিচারসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অধস্তন আদালত কার্যক্রমের অন্য যেকোনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে এই কমিটি এখতিয়ারপ্রাপ্ত। কিন্তু কমিটির চোখের সামনে আইন মন্ত্রণালয়ে বেআইনি তৎপরতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ চলছে।
প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের অনধিক ১৪ জন বিচারপতিকে নিয়ে তাঁর একক সিদ্ধান্তে উল্লিখিত তিনটি স্থায়ী কমিটি নিয়োগ দেবেন। এই ১৪ জন বিচারকের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কী হবে, সে বিষয়ে বিধিতে কিছু বলা হয়নি। অথচ বিচার প্রশাসনের সাফল্য-ব্যর্থতায় তাঁরা বিরাট ভূমিকা রাখবেন।
অধস্তন আদালতের ব্যবস্থাপনা কী হবে, সে বিষয়ে মাথা ঘামাতে সংসদ বা সংসদীয় কমিটি নারাজ। আর সুপ্রিম কোর্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অধস্তন আদালতের বিচারকেরা একটি বিশেষ আইনে দায়মুক্তি ভোগ করেন। আইন বলছে, বিচার করতে বসে তাঁরা ভুল করলেও তা দণ্ডনীয় নয়, তবে সেই ভুলটা সদ্বিশ্বাসে করতে হবে। তাঁরা ভুল করলে আমলা কায়দায় তাঁদের কাঠগড়ায় তোলা যায় না। কোনো ত্রুটিপূর্ণ রায় বা জামিনের আদেশ যাচাই করা উচ্চ আদালতের কাজ। কোনো বিচারক ভালো বিশ্বাসে আদেশ না দিলে তা তদন্তযোগ্য। হাইকোর্ট রায় দিতে গিয়ে আপত্তিকর কিছু দেখলে ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট বিচারকের ডোশিয়ারে রাখেন। এতে পরে তাঁদের পদোন্নতি আটকে যায়। মারাত্মক অপরাধ ঘটলে দ্রুত বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা রয়েছে। সেটাও করার দায়িত্ব সংবিধান হাইকোর্টকে দিয়েছে। কিন্তু সেটা কোনো মানদণ্ডেই আদালতে দাঁড় করিয়ে রাখার প্রক্রিয়ায় নয়। অথচ কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটছে। অভাবনীয় ঘটনা ঘটছে।
নতুন বিধান করা হয়েছে, আইনজীবীরা শুনানিকালে ল্যাপটপ কিংবা একই ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন। অথচ এর পরের বিধানটি সংঘাতপূর্ণ মনে হয়। এতে বলা আছে, শুধু বিচারক ভয়েস রেকর্ডিং যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন। বিচারকের অনুমতি নিয়ে আদালতের স্টাফরাও তা পারবেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী বিশেষ করে গণমাধ্যমের কর্মীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন কেন?
ওয়াশিংটনে একটা বই কিনেছিলাম। প্রচ্ছদে ভয়েস রেকর্ডিংয়ের ছবি। ভেতরে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের কতিপয় মাইলফলক মামলায় আইনজীবী ও বিচারকের সওয়াল-জবাবের টেপ করা পূর্ণ বিবরণ। সংসদের সংলাপ জাতি শুনছে। প্রকাশ্য আদালতের সংলাপ জাতির শুনতে বাধা কী। এটা তো একটি ভয়ংকর বিধান, ‘কোনো ব্যক্তি আদালতের বিচারকার্যের কথোপকথন রেকর্ড করতে পারবে না।’
তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে মিছিল-মিটিং করার বিরুদ্ধে বিচারপতি আবদুল মতিনের দেওয়া সেই রায়টি অন্তর্ভুক্ত করা। ওই রায়টির শত ভাগ বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে, আদালতকক্ষের বারান্দায় আওয়ামী, বিএনপি ও জামায়াতি আইনজীবীদের উল্লম্ফন চিরতরে বন্ধ হোক। বিচারপতি মতিনের রায় দুই বড় দলের ডাকসাইটে আইনজীবীদের আমরা লঙ্ঘন করতে দেখেছি। লঙ্ঘনকারীদের পুরসৃ্কত হতেও দেখেছি। প্রশ্ন হলো, যাঁরা রায় মানেন না, তাঁরা রুলস মানবেন?
নতুন বিধান বলেছে, ‘কোনো ব্যক্তি তিনি আইনজীবী সমিতির সদস্য বা যে-ই হোন, তিনি আদালত চত্বরে কিংবা আদালত ভবনের কোনো অংশে কোনো ধরনের শোভাযাত্রা কিংবা স্লোগান দেওয়া কিংবা সভার আয়োজন করা কিংবা আদালত চত্বরে সমাবেশ আয়োজন করতে পারবেন না।’
হাইকোর্ট রুলস সংস্কারের কাজে বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি আনোয়ারুল হক, বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার, বিচারপতি খন্দকার মূসা খালেদ, বিচারপতি এমদাদুল হক প্রমুখ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্নের জন্য তাঁদের অভিবাদন। আগাম অভিবাদন যদি তাঁরা অল্প সময়ে বাংলায় এটি তাঁরা সম্পন্ন করেন।
হাইকোর্ট রুলসে অনেক ভালো বিধান করা হয়েছে, যা অনুসরণ করা হলে বিচার অঙ্গনের চিত্র কিছুটা বদলাবে। ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানি কমবে।
কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, এই আইন না-মানা হলে তার প্রতিকার কী হবে। আইনের কোথাও বলা হয়নি এর লঙ্ঘন ঘটলে শাস্তি কী হবে। তবে আইন ভাঙা যে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে, সে কথা বলার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাতীয় সংসদ।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারপতি মিজানুর রহমান ভূইয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এ রকম বহু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো ঘটনার নজির আছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জুডিশিয়াল কাউন্সিল একটি ঘুমন্ত প্রতিষ্ঠান। এটিকে যে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, সেটা আপাতত কম প্রাপ্তি নয়। স্পিকার আগে রুলিং দিয়েছেন। কাউন্সিলের ঘুম ভাঙেনি। এবার শুধু বলেছেন রুলিং দেব। তাতেই এর ঘুম ভাঙছে। একটা দ্বিমুখী নীতি স্পষ্ট। হাইকোর্ট রুলস অনুসরণে কি দ্বিমুখী কিংবা মুখচেনা নীতির অবসান ঘটবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
সময়ের আলোচিত বিষয় আদালত অবমাননা। নতুন বিধিতে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে সুয়োমোটো কিংবা স্বপ্রণোদিত রুল দেওয়া নিয়ে একটা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে দোষণীয় কিছু প্রকাশিত হলে হাইকোর্ট আর তাৎক্ষণিক রুল জারি করবেন না। পত্রিকা হলে তার প্রকাশক, সম্পাদক ও রিপোর্টারের কাছে নোটিশ পাঠাবেন। এর মাধ্যমে তারা প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। এতকাল হাইকোর্টের সুয়োমোটো রুলগুলো কার্যত সংবিধানের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করছিল। কারণ, সংবিধান বলেছে হাইকোর্ট শুধু কোনো আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করবেন। কিন্তু হাইকোর্ট আবেদন ছাড়াই রুল জারি করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
সংসদের মতো সুপ্রিম কোর্ট এবার তিনটি স্থায়ী কমিটি সৃষ্টি করেছেন। একটি কমিটি হাইকোর্টের মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি তদারক করবে। আরেকটি কমিটি অধস্তন আদালতের ব্যবস্থাপনা দেখবে। আরেকটি কমিটি হাইকোর্টের চালু করা রুলস বাস্তবায়ন তদারক করবে।
সুপ্রিম কোর্টে প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞের একটি বড় বিষয় হচ্ছে মোশন। মোশন পিটিশনগুলোতে জরুরি বিষয়ে জরুরি প্রতিকার প্রার্থনা করা হয়। তবে এর শুনানি অনুষ্ঠানে বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। পরিচিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকে বেশি সুযোগ পেতেন। অনেক কনিষ্ঠ তা দেখে ব্যথিত হতেন। এবার ক্রমিক নম্বর অনুসরণের দাওয়াই এসেছে। নির্দিষ্ট বিচারিক আদেশ ছাড়া ক্রমিক অদলবদল করা যাবে না। এই ক্রমিক ওপর-নিচ করা নিয়ে কেরানিরা বাণিজ্য করতেন বলে অভিযোগ আছে। অনেক আইনজীবী রিট পিটিশন দাখিল করেই একটা অন্যায্য ফায়দা নিতেন। রিট দাখিল করেই আইনজীবী সনদ দিতেন যে মামলা বিচারাধীন। এতে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হন। নিম্ন আদালতও বিভ্রান্ত হন। এরপর শুনানি না করে রিট আবেদন তুলে নিতেন। এখন নিয়ম করা হয়েছে আবেদন একবার দায়ের করলে শুনানি ছাড়া তা ফেরত নেওয়া যাবে না। যেসব মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হবে, তা আগেই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
আগে কোনো জামিনের দরখাস্ত এক বেঞ্চে নাকচ হলে সে তথ্য গোপন করে অনেক আইনজীবী অন্য বেঞ্চে তা দাখিল করতেন। এখন নিয়ম করা হয়েছে, একই বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে নতুন করে দরখাস্ত করলে আগের ফলাফল অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। এ ধরনের বহু বিষয় আছে যা নিয়ে উচ্চ আদালতে ভয়ানক অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। দুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট লাইব্রেরিতে আলাপকালে কয়েকজন আইনজীবী অবশ্য বললেন, আইন করা এক জিনিস আর তা বাস্তবায়ন এ দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
অধস্তন আদালতের চলতি প্রশাসনিক কাঠামো যথারীতি লেজেগোবরে অবস্থায় আছে। শাসক দল এভাবে রেখেই তার মেয়াদ পার করল। কেউ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে সাহসই পায়নি।
অন্ধ থেকে প্রলয় বন্ধ রাখার নীতি চলছে। তাই এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, হাইকোর্টের নতুন আইনে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিএ কমিটির কার্যক্রম দক্ষতর করে তোলা হয়নি। এমনকি বিস্ময়করভাবে রুলস সংশোধন কমিটি সংবিধানের ১১৬, ১০৯ অনুচ্ছেদ, মাসদার হোসেন ও কাজি হাবিবুল আউয়ালের মামলার রায়ের নির্দেশনা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্টের অনধিক চার বিচারপতি নিয়ে জিএ কমিটি গঠিত। বিচারসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অধস্তন আদালত কার্যক্রমের অন্য যেকোনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে এই কমিটি এখতিয়ারপ্রাপ্ত। কিন্তু কমিটির চোখের সামনে আইন মন্ত্রণালয়ে বেআইনি তৎপরতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ চলছে।
প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের অনধিক ১৪ জন বিচারপতিকে নিয়ে তাঁর একক সিদ্ধান্তে উল্লিখিত তিনটি স্থায়ী কমিটি নিয়োগ দেবেন। এই ১৪ জন বিচারকের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কী হবে, সে বিষয়ে বিধিতে কিছু বলা হয়নি। অথচ বিচার প্রশাসনের সাফল্য-ব্যর্থতায় তাঁরা বিরাট ভূমিকা রাখবেন।
অধস্তন আদালতের ব্যবস্থাপনা কী হবে, সে বিষয়ে মাথা ঘামাতে সংসদ বা সংসদীয় কমিটি নারাজ। আর সুপ্রিম কোর্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অধস্তন আদালতের বিচারকেরা একটি বিশেষ আইনে দায়মুক্তি ভোগ করেন। আইন বলছে, বিচার করতে বসে তাঁরা ভুল করলেও তা দণ্ডনীয় নয়, তবে সেই ভুলটা সদ্বিশ্বাসে করতে হবে। তাঁরা ভুল করলে আমলা কায়দায় তাঁদের কাঠগড়ায় তোলা যায় না। কোনো ত্রুটিপূর্ণ রায় বা জামিনের আদেশ যাচাই করা উচ্চ আদালতের কাজ। কোনো বিচারক ভালো বিশ্বাসে আদেশ না দিলে তা তদন্তযোগ্য। হাইকোর্ট রায় দিতে গিয়ে আপত্তিকর কিছু দেখলে ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট বিচারকের ডোশিয়ারে রাখেন। এতে পরে তাঁদের পদোন্নতি আটকে যায়। মারাত্মক অপরাধ ঘটলে দ্রুত বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা রয়েছে। সেটাও করার দায়িত্ব সংবিধান হাইকোর্টকে দিয়েছে। কিন্তু সেটা কোনো মানদণ্ডেই আদালতে দাঁড় করিয়ে রাখার প্রক্রিয়ায় নয়। অথচ কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটছে। অভাবনীয় ঘটনা ঘটছে।
নতুন বিধান করা হয়েছে, আইনজীবীরা শুনানিকালে ল্যাপটপ কিংবা একই ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন। অথচ এর পরের বিধানটি সংঘাতপূর্ণ মনে হয়। এতে বলা আছে, শুধু বিচারক ভয়েস রেকর্ডিং যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন। বিচারকের অনুমতি নিয়ে আদালতের স্টাফরাও তা পারবেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী বিশেষ করে গণমাধ্যমের কর্মীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন কেন?
ওয়াশিংটনে একটা বই কিনেছিলাম। প্রচ্ছদে ভয়েস রেকর্ডিংয়ের ছবি। ভেতরে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের কতিপয় মাইলফলক মামলায় আইনজীবী ও বিচারকের সওয়াল-জবাবের টেপ করা পূর্ণ বিবরণ। সংসদের সংলাপ জাতি শুনছে। প্রকাশ্য আদালতের সংলাপ জাতির শুনতে বাধা কী। এটা তো একটি ভয়ংকর বিধান, ‘কোনো ব্যক্তি আদালতের বিচারকার্যের কথোপকথন রেকর্ড করতে পারবে না।’
তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে মিছিল-মিটিং করার বিরুদ্ধে বিচারপতি আবদুল মতিনের দেওয়া সেই রায়টি অন্তর্ভুক্ত করা। ওই রায়টির শত ভাগ বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে, আদালতকক্ষের বারান্দায় আওয়ামী, বিএনপি ও জামায়াতি আইনজীবীদের উল্লম্ফন চিরতরে বন্ধ হোক। বিচারপতি মতিনের রায় দুই বড় দলের ডাকসাইটে আইনজীবীদের আমরা লঙ্ঘন করতে দেখেছি। লঙ্ঘনকারীদের পুরসৃ্কত হতেও দেখেছি। প্রশ্ন হলো, যাঁরা রায় মানেন না, তাঁরা রুলস মানবেন?
নতুন বিধান বলেছে, ‘কোনো ব্যক্তি তিনি আইনজীবী সমিতির সদস্য বা যে-ই হোন, তিনি আদালত চত্বরে কিংবা আদালত ভবনের কোনো অংশে কোনো ধরনের শোভাযাত্রা কিংবা স্লোগান দেওয়া কিংবা সভার আয়োজন করা কিংবা আদালত চত্বরে সমাবেশ আয়োজন করতে পারবেন না।’
হাইকোর্ট রুলস সংস্কারের কাজে বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি আনোয়ারুল হক, বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার, বিচারপতি খন্দকার মূসা খালেদ, বিচারপতি এমদাদুল হক প্রমুখ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্নের জন্য তাঁদের অভিবাদন। আগাম অভিবাদন যদি তাঁরা অল্প সময়ে বাংলায় এটি তাঁরা সম্পন্ন করেন।
হাইকোর্ট রুলসে অনেক ভালো বিধান করা হয়েছে, যা অনুসরণ করা হলে বিচার অঙ্গনের চিত্র কিছুটা বদলাবে। ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানি কমবে।
কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, এই আইন না-মানা হলে তার প্রতিকার কী হবে। আইনের কোথাও বলা হয়নি এর লঙ্ঘন ঘটলে শাস্তি কী হবে। তবে আইন ভাঙা যে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে, সে কথা বলার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাতীয় সংসদ।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারপতি মিজানুর রহমান ভূইয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এ রকম বহু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো ঘটনার নজির আছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জুডিশিয়াল কাউন্সিল একটি ঘুমন্ত প্রতিষ্ঠান। এটিকে যে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, সেটা আপাতত কম প্রাপ্তি নয়। স্পিকার আগে রুলিং দিয়েছেন। কাউন্সিলের ঘুম ভাঙেনি। এবার শুধু বলেছেন রুলিং দেব। তাতেই এর ঘুম ভাঙছে। একটা দ্বিমুখী নীতি স্পষ্ট। হাইকোর্ট রুলস অনুসরণে কি দ্বিমুখী কিংবা মুখচেনা নীতির অবসান ঘটবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
ইমেইলঃ mrkhanbd@gmail.com
Discussion about this post