আইনের ধারা মনে রাখার কৌশল
আইনের ধারা মনে রাখার কৌশল কি সহজ? হ্যা, সহজ তবে বিশ্বে এমন কোন আইনবিদ নেই, যিনি বলতে পারবেন তার আইনের সকল ধারাসমূহ মুখস্ত । পৃথিবীতে একমাত্র মহাগ্রন্থ আল কোরআন ছাড়া আজ পর্যন্ত এমন কোন গ্রন্থের উৎভব সম্ভব নয় এবং সম্ভব হবেও না ।
আইন এমন একটি বিষয় যার গুরুত্ব অত্যান্ত ব্যাপক । আইনের হাজার হাজার ধারা রয়েছে । প্রতি নিয়ত নতুন নতুন আইন তৈরী হয় এবং অনেক পুরোনো আইনের ধারা সংযোজন, বিয়োযোজন হয়।
আইনের ধারা যেহেতু সম্পূর্ণ মনে রাখা সম্ভব নয় কিন্তু মামলার তাগিয়ে বা প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিনিয়ত যে ধারা গুলোর ব্যবহার হয়ে আসছে, যে ধারা গুলো সম্পর্কে একেবারেই না জানলে আপনি একজন দক্ষ আইজীবী হতে পারবেন না এবং একজন আইনের ছাত্র হিসেবে নিজেকে দাবি করলে আপনার লজ্জার কারণ হয়ে দাড়াতে পারে ।
চলুন জেনে নেওয়া যাক আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা মনে রাখার কৌশল সমূহঃ-
প্লান-১ প্রথমেই আপনি একুট চিন্তা করূন আপনি কোন সাধারণ পড়া পড়ছেন না ধারা মুখস্ত করতে যাচ্ছেন। সুতরাং আপনি যতটুকু সময় মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারবেন ঠিক ততটুকু সময় মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং পড়ার জন্য আগ্রই তৈরী করুন।
যথা সময়ে আগ্রহ বা মনোযোগ বা উক্ত সময়ে পড়ায় মন মানসিকতা না থাকলে বা পড়ায় মন না বসলে, যখন আপনার মন ফ্রেশ খাকে বা পড়ায় আগ্রহ তৈরী করার উপযুক্ত সময় পাওয়া যায় উক্ত সময়ে যতুটুকু সময় আপনি পড়ার জন্য ব্যয় করতে পারবেন ঠিক সেই সময়ে আপনি আইনের ধারা সমূহ মুখস্ত করতে বসুন।
প্লান-২ আইনের কোন বই পড়ার সাথে সাথে একটু চিন্তা করূন আপনি যে বইটি পড়ছেন সেই বইটির কি কি বিষয় আপনার আগে জানা দরকার লক্ষ করূনঃ-
নিজেকে প্রশ্ন করুন আইনটির :- (১) কয়টি ধারা রয়েছে? (২) কয়টি অধ্যায় রয়েছে?(৩) কত নম্বর আইন ? (৪) আইনটির প্রকাশকাল কত সাল ?
(৫) আইনটি কত সালে কার্যকর হয়? (৫) আইনটির ধরন/প্রকৃতি? (৬) আইনটি সর্বশেষ কত সালে সংশোধন হয় ? (৭) মোর্ট তফসিল কতটি
(৮) কতটি তফসিল বলবৎ আছে? (৯) কতটি তফসিল বাতিল হয়েছে? (১০) কতটি ধারা বাতিল করা হয়েছে ? (১১) বর্তমানে কতটি ধারা বলবৎ রয়েছে?
এই সকল বিষয় গুলো প্রথমে আপনাকে আয়ত্ব করতে হবে ।
প্লান -৩ এবার প্লান করূন যে আইনের বইটি আপনি পড়ছেন সেই আইনের বইটির ধারা গুলো আগে নির্বাচন করূন।
প্লান -৪ আইনের যে কোন বিষয়ের শুরুর ধারা এবং শেষ ধারা মনে রাখার চেষ্টা করূন এতে করে বিষটির সম্পূর্ণ অংশ মাথায় রাখতে সুভিধা হবে , এটাও একটি কৌশল যেমনঃ- চুরি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বাংলাদশ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৮ নং ধারায় এবং শেষ করা হয়েছে ৩৮২ নং ধারার মাধ্যমে।
প্লান-৫ আমি মনে করি আপনারা যদি এই ৫ টি প্লান অনুসরণ করেন ও প্রতিনিয়ত অধ্যায়ন করেন এবং মূল বই সহ গাইড বই পড়তে থাকেন, তাহলে আইনের ধারা সমূহ রপ্ত করতে সক্ষম হবেন ইনশাআল্লাহ ।
চুলুন আমরা প্লান অনুযায়ী আইনের ধারা সমূহ মুখস্ত করার কৌশলটি প্রাকট্রিক্যালি অনুসরণ করার চেষ্টা করি।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর গুরুত্বপূর্ণ আইনের ধারা মনে রাখার কৌশল:-
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (The Penal code,1860)
- প্রথম আইন কমিশন গঠিত হয় = ১৮৩৪ সালে
- প্রথম আইন কমিশনের চেয়োরম্যান ছিলেন = লর্ড ম্যাকুলি
- দন্ডবিধি প্রণয়ন হয় = ৬ অক্টোবর ১৮৬০ সালে
- দন্ডবিধি কার্যকর হয় = ১৮৬২ সালের ১ জানুয়ারি
- মোট ধারা = ৫১১ টি
- মোট অধ্যায় = ২৩ টি
- আইনের ধরণ/প্রকৃতি = মৌলিক আইন/মূল আইন
- দন্ডবিধি কত নং আইন = ১৮৬০ সালের ৪৫ নং আইন
- সর্বশেষ সংশোধন = ২০০৪ সালে ৮২ এবং ৮৩ নম্বর ধারা সংশোধন করা হয় ।
- দন্ড বিধির প্রথম শাস্তির ধারা-১০৯
- দন্ড বিধির শেষ শাস্তির ধারা- ৫১১
- সবচেয়ে কম শাস্তির ধারা – ৫১০
- সবচেয়ে বেশি শাস্তির ধারা- ৩০৩
- দন্ডবিধিতে শুধুমাত্র জরিমানা দন্ডের ধারা- ১২৩-১২৮,১৩০,১৩৪,১৩৭,১৫৪-১৫৬,১৭১,১৭৬,২৬৩ক,২৭৮,২৮৩,২৯০,২৯৪ক,৩৮০,৪৫৭।
- দন্ডবিধিতে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির ধারা- ১২৬,১২৭,১৬৯।
- দন্ডবিধিতে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের ধারা– ১২১,১২১ক,১২২,১২৪ক,১২৫,১২৮,১৩০,১৩২,১৯৪,১৯৫,২২৫,২২৫ক,২২৬,২৩২,২৩৩,২৫৫,৩০২,৩০৪,৩০৫,৩০৭,৩১১-৩১৫,৩২৬,৩২৯,৩৬৪,৩৭১,৩৭৬,৩৭৭,৩৮৮,৩৮৯,৩৯৪,৩৯৬,৪০০,৪০৯,৪১২,৪১৩,৪৩৬,৪৩৭,৪৪৯,৪৫৯,৪৬০,৪৬৭,৪৭২,৪৭৪,৪৭৫,৪৭৭ ।
- দন্ডবিধিতে মৃত্যুদন্ডের ধারা– ১২১,১৩২,১৯৪,৩০২,৩০৩,৩০৫,৩০৭(২),৩৯৬।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (The Penal code,1860)এর ২৩ টি অধ্যায়ের মূল বিষয় বস্তুর শুরু এবং শেষঃ-
ধারা অধ্যায় আলোচানার বিষয় বস্তু
- ধারা ১-৫ = প্রথম অধ্যায় = প্রারম্ভিক বিষয়ক আলোচনা/ সূচনা/ভুমিকা
- ধারা ৬-৫২ক = দ্বিতীয় অধ্যায় = সাধারণ ব্যাখ্যা
- ধারা ৫৩-৭৫ = তৃতীয় অধ্যায় = দন্ড সমূহ
- ধারা ৭৬-১০৬ = চতুর্থ অধ্যায় = সাধারণ ব্যতিক্রম সমূহ
- ধারা ১০৭-১২০ = পঞ্চম অধ্যায় = অপরাধে সহায়তার বিষয় সমূহ
- ধারা ১২০ক -১২০খ = পঞ্চম ক অধ্যায় = অপরাধমুলক ষড়যন্ত্র
- ধারা ১২১-১৩০ = ষষ্ঠ অধ্যায় = রাষ্ট্রোবিরোধী অপরাধসসমূহ
- ধারা ১৩১-১৪০ = সপ্তম অধ্যায় = সেনাবাহিনী,নৌবাহিনী,বিমানবাহিনী সম্পর্কিত অপরাধসমূহ
- ধারা ১৪১-১৬০ = অষ্টম অধ্যায় = জনসাধারণ এর শান্তি বিরোধী সংক্রান্ত অপরাধ
- ধারা ১৬১-১৭১ = নবম অধ্যায় = সরকারি কর্মচারী সংক্রান্ত অপরাধসমুহ
- ধারা ১৭১ক-১৭১ঝ = নবম ক অধ্যায় = নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ১৭২-১৯০ = দশম অধ্যায় = সরকারি কর্মচারীগণের আইনানুগ ক্ষমতা অবমাননা সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ)
- ধারা ১৯১-২২৯ = এগারো অধ্যায় = মিথ্যা সাক্ষ্যদানের অপরাধ সমূহ
- ধারা ২৩০-২৬৩ ক = বারো অধ্যায় = মুদ্রা সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ২৬৪-২৬৭ = তের অধ্যায় = ওজন ও পরিমাপ সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ২৬৮-২৯৪ খ = চৌদ্দ অধ্যায় = জনসাস্থ,নিরাপত্তা, শালীনতা ও নৈতিকতা সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ২৯৫-২৯৮ = পনেরো অধ্যায় = ধর্মসংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধার ২৯৯- ৩৭৭ = ষোল অধ্যায় = মানবদেহ ও জীবন ক্ষুন্নকারী অপরাধ সংক্রান্ত
- ধারা ৩৭৮-৪৬২ খ = সতেরো অধ্যায় = সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ৪৬৩–৪৮৯ ঙ = আঠারো অধ্যায় = দলিলাদি এবং ব্যবসায় বা সম্পত্তি চিহ্ন সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ৪৯০–৪৯২ = ঊনিশ অধ্যায় = অপরাধমুলকভাবে চাকরি-চুক্তি ভঙ্গকরন সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ৪৯৩-৪৯৮ = বিশ অধ্যায় = বিবাহ সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ৪৯৯-৫০২ = একুশ অধ্যায় = মানহানি সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ
- ধারা ৫০৩-৫১০ = বাইশ অধ্যায় = অপরাধমুলক ভীতি প্রদর্শন, অপমান, অনিষ্টকাজ ও বিরক্তকরন সম্পর্কিত
- ধারা ৫১১ = তেইশ অধ্যায় = অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ সম্পর্কিত অপরাধ
বি;দ্র:- মনে রাখবেন দণ্ডবিধিতে সবসময় শাস্তির ধারা দিয়ে মামলা করতে হয় ।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (The Penal code,1860)এর গুরুত্বপূর্ণ ধারার সংজ্ঞা সমূহঃ-
- অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ১২০(ক) ধারা
- বেআইনি সমাবেশ ১৪১ ধারা
- দাঙ্গা ১৪৬ ধারা
- মারামারি ১৫৯ ধারা
- মিথ্যা সাক্ষ্য ১৯১ ধারা
- মুদ্রা ২৩০ ধারা
- অপরাধজনক নরহত্যা ২৯৯ ধারা
- খুন ৩০০ ধারা
- ঠগ ৩১০ ধারা
- আঘাত ৩১৯ ধারা
- গুরুতর আঘাত ৩২০ ধারা
- অবৈধ বাধা ৩৩৯ ধারা
- অবৈধ আটক ৩৪০ ধারা
- আক্রমণ ৩৫১ ধারা
- অপহরণ ৩৫৯ ধারা
- অপবাহন ৩৬২ ধারা
- ধর্ষণ ৩৭৫ ধারা
- চুরি ৩৭৮ ধারা
- বলপ্রয়োগ ৩৮৩ ধারা
- দস্যুতা ৩৯০ ধারা
- ডাকাতি ৩৯১ ধারা
- অসাধুভাবে সম্পত্তি আত্মসাৎ ৪০৩ ধারা
- অপরাধমূলক বিস্বাসভঙ্গ ৪০৬ ধারা
- চোরাইমাল ৪১০ ধারা
- প্রতারণা ৪১৫ ধারা
- অনিষ্ট ৪২৫ ধারা
- অপরাদজনক অনধিকার প্রবেশ ৪৪১ ধারা
- জালিয়াতি ৪৬২ ধারা
- মানহানি ৪৯৯ ধারা
অপরাধের প্রকারভেদঃ-
জামিনের ক্ষেত্রে অপরাধ ২ প্রকার –
- জামিনযোগ্য অপরাধ (সি আর পি সি- ৪৯৬ ধারা)
- জামিন অযোগ্য( ৪৯৭ ধারা)
আমলের ক্ষেত্রে অপরাধ ২ প্রকার –
- আমলযোগ্য অপরাধ (জি আর মামলা (C/R)
- আমল অযোগ্য অপরাধ ( সি আর মামলা ( G/R)
আপোস-মিমাংসার ক্ষেত্রে অপরাধ ৩ প্রকার
- মীমাংসা যোগ্য অপরাধ
- অমীমাংসা যোগ্য অপরাধ
- আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মীমাংসা যোগ্য অপরাধ।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (The Penal code,1860) এর আলোকে যাদের কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবেনা তা নিচে দেওয়া হলো:-
- বিচারকের কাজ
- বিচারকের নির্দেশ
- দুর্ঘটনার ফলে কৃত কাজ
- ৯ বছরের কম শিশুর কাজ
- ১২ বছরের কম অপরিণত শিশুর কাজ
- অনিচ্ছাকৃত মাতালের কাজ
- পাগলের কাজ
- সরল বিস্বাস এ কৃত কাজ
- কারো মঙ্গলারথে কৃত কাজ
- তুচ্ছ কোন কাজ
- সম্মতিক্রমে কাজ
- ঊর্ধতন কর্মকর্তার কাজ
বি;দ্র: পাগলের কাজ অপরাধ না হলেও আত্ম রক্ষায় পাগল কেউ মারা যাবে( ধারা ৯৮)
পরিশেষে বলা যায় যে উপরে উল্লেখ্যিত ৫ টি কৌশল অনুসরণ করে আইনের ধারা সমুহ মুখস্ত করলে, খুব সহজেই ধারা মনে রাখা সম্বব।
ফৌজদারী কার্যবিধি আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
লেখকঃ ল ফর ন্যাশনস, ইমেইলঃ lawfornations.abm@gmail.com, ওয়েবসাইটঃ www.lawfornations.com, মোবাইল: 01842459590.
আরো জানুন আইন কি? আইন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেতে ক্লিক করুন
Discussion about this post