তানভীর চৌধুরী:
যদি আমি আপনাকে প্রশ্ন করি কেন আপনি আপনার পাশের একজন নিরীহ মানুষ বা আপনার শত্রুকে খুন করছেন না কিংবা তার সম্পত্তি কেন দখল করছেন না? তখন আপনি যা বলবেন তা অনেকটাই এমন হবে যে, খুন করা এবং অন্যের সম্পত্তি অন্যায় ভাবে দখল করা দুইটাই অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। আবার যদি জিজ্ঞাসা করি, এটা আপনি কোথা থেকে জানলেন, আপনার উত্তর হবে দেশের আইন থেকে। তাহলে আমরা পাচ্ছি, আইন অপরাধকে চিহ্নিত করে এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রাখে যাতে মানুষ অপরাধ থেকে দূরে থাকে। প্রকৃত পক্ষে আইন তৈরীর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, মানুষকে অপরাধ সম্বন্ধে সচেতন করা এবং জনগণকে অপরাধ থেকে দূরে রাখা। কেউ যদি আইন অমান্য করে কিংবা অন্যের অধিকার ভঙ্গ করে, তবে তাকে আইনে অভিযুক্ত করা হবে, অভিযুক্তের বিচার এবং শাস্তির বিধান দেওয়া হবে। আরও একটি বিষয় জানিয়ে রাখি, আমাদের দণ্ডবিধির ১০৮ ধারায় প্ররোচনা দাতার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কোন অপরাধ করার ক্ষেত্রে মূল অপরাধীকে সাহায্য করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত এবং বিভিন্ন অপরাধের প্ররোচনার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধারাতে।
উপরের আলোচনা আমরা এতটুকু বুঝতে সক্ষম হচ্ছি যে, আইনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, অপরাধকে চিহ্নিত করা, জনগণকে সচেতন করা এবং কেউ তা অমান্য করলে তাকে শাস্তি দেওয়া এবং সর্বদা এর সাহায্যকারীকেও আইনের আওতাভুক্ত করা। কিন্তু, আইন নিজে যদি কোন অপরাধকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করে দেয় কিন্তু এর জন্য কোন শাস্তির বিধান না রাখে, তাহলে নিশ্চয়ই মানুষ সেই অপরাধকে সংগঠন না করে থাকবে না। জাতি হিসেবে আমরা যেখানে আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পছন্দ করি, সেখানে আইনে শাস্তির বিধান না থাকলে তো অপরাধের উৎসাহ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই দেখা যায়, মানুষ ফুট ওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও যানজট সৃষ্টি করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে; ট্রাফিক সিগনালে লাল বাতি জ্বলা অবস্থায় গাড়ি চলে আর সবুজ বাতি জ্বলা অবস্থায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে; প্রকাশ্যে পাবলিক অবস্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ অথচ সাধারণ জনগণের পাশাপাশি আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও এই আইন প্রতি সেকেন্ডেই অমান্য করছে ইত্যাদি হাজারও আইনের ভঙ্গ সচরাচর হচ্ছে, যা অন্যায় তথা অপরাধ ছাড়া কিছু নয়। এই হল আমাদের দেশের আইন এবং আইনের শাসন। এখন আমাদের দেশে প্রায় যে অপরাধটি পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, তা হল নারী ধর্ষণ। যদি আজ আইন করা হয়, এটা একটি অপরাধ কিন্তু এর জন্য কোন শাস্তির বিধান নেই, তাহলে কাল কি হবে তা আমার দ্বারা চিন্তা করা অসম্ভব প্রায়, তাই পাঠকের চিন্তার উপরই ছেড়ে দিলাম। এতটুকু ধারণা করতে পারি, দেশে আবার একাত্তর নেমে আসবে হয়ত তার চেয়ে বেশী কিছু হতে পারে। এত কিছু বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা না জানলেও আমাদের দণ্ডবিধিতে এমন একটি গুরুতর অপরাধ রয়েছে, যা সংগঠনের ফলে শুধুমাত্র মূল অপরাধীকে শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে অথচ প্ররোচনা দাতাকে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। আর, তা হল ব্যভিচার।
দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় বিবাহের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য এর ব্যভিচারকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, “কোন লোক যদি, অপর কোন নারীর স্বামীর বিনা সম্মতিতে বা যৌণকামনার উপস্থিতি ছাড়া যৌণসঙ্গম করে, যে নারী অপর কোন পুরুষের এরূপ যৌণসঙ্গম ধর্ষণের অপরাধ না হলে, সে লোক ব্যভিচার করেছে বলে পরিগণিত হবে ও তাকে যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় দণ্ডে শাস্তিযোগ্য হবে। এরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটি দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে না”। এ থেকে পেলাম, ধর্ষণ ছাড়া কোন বিবাহিত স্ত্রী লোকের সাথে তার স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌণ সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ব্যভিচার এবং শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর বা জরিমানা বা উভয় কিন্তু তা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়। যেহেতু, ধর্ষণ নয় অর্থাৎ বুঝা যাচ্ছে, এখানে নারীর সম্মতি ছিল। যেখানে নারীর সম্মতি রয়েছে সেখানে কেনই বা তাকে শাস্তির বাহিরে রাখা হল। প্রশ্ন এভাবে করা যায়, ‘যেখানে সকল অপরাধী এবং প্ররোচনা দাতা উভয়কে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ব্যভিচারকে কেন ব্যতিক্রম করা হল?’ যেখানে পরিবার, সংসার, প্রেম, ভালবাসা সব ক্ষেত্রেই পরক্রিয়াকে সুখ নষ্টকারী হিসেবে বলা হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশীয় আইনে নারীকে পরক্রিয়া তথা ব্যভিচারের প্ররোচনা দাতা হিসেবে কোন শাস্তির অধীন রাখা হল না। এই থেকে কি আমরা বলতে পারি না যে, ‘আইন নারীকে ব্যভিচারে উৎসাহিত করছে?’ অনেকেই হয়তো বলবে, নারীকে উৎসাহিত নয়, নারীকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে; কেননা, পুরুষের প্রলোবনে পড়ে নারী হয়ত এই অপরাধ করতে পারে। কিন্তু, এই প্রলোবন তো নারীও দেখাতে পারে। কেননা, যৌণসঙ্গম সংক্রান্ত ব্যাপারে যে সব সময় পুরুষ উৎসাহী তা কিন্তু নয়; এমনও তো হতে পারে স্ত্রীলোকটি নিজেই মূল অপরাধী এবং পুরুষ সাহায্যকারী, কিন্তু আমাদের আইনে কোন আলামত ছাড়াই নারীকে সরাসরি প্ররোচনা দাতা বলে দায়মুক্ত করছে অন্য দিকে পুরুষের কথা চিন্তা না করেই সরাসরি শাস্তির বিধান রেখেছে।
আবার, যেখানে নারী ও পুরুষকে আমাদের সংবিধান সমান অধিকার দিয়েছে সেখানে আমরা কীভাবে একই অপরাধের জন্য পুরুষকে শাস্তি দিচ্ছি অথচ নারীকে সরাসরি দায়মুক্ত করছি? এই প্রশ্নের উত্তরও পাঠকের কাছে। আরও একটি ব্যাপার হল, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বামীকেই অভিযোগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে অভিভাবককে। যার কারণে, স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে নিজের প্রতিপক্ষকে ব্যভিচারের ফাঁদে ফেলতে পারে কেননা, স্ত্রীর জন্য কোন শাস্তির বিধান নেই। আবার, যে কোন নারী তার প্রেমের ফাঁদে ফেলে আইনের এই ফাঁক কাজে লাগাতে পারে। এই থেকে দেখা যাচ্ছে, এই আইনের শুধু অপব্যবহারই সম্ভব। তাই, সরকারের উচিত সংবিধানের ২৭ এবং ২৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আইনের দৃষ্টিতে সমতা অর্থাৎ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন ইত্যাদি মেনে ব্যভিচারের বিধানটি সংশোধন করা। নহেত এই বিধান সংবিধান পরিপন্থী বলে সর্বদা সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, যা আইন হয়েও আইনের উদ্দেশ্যের সাথে পরিপন্থী।
আর একটি মজার ব্যাপার জেনে রাখা ভালো, আমাদের দণ্ডবিধিটি তৈরী করা হয় ১৮৬০ সালে, সাল দেখেই বুঝতে পারছেন আইনটি ব্রিটিশ সরকারের তৈরী; কিন্তু মজার ব্যাপার হল যারা আমাদের আইনে ব্যভিচারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে(যদিও কেবল পুরুষের শাস্তির বিধান), তারাই কিনা নিজেদের দেশে ব্যভিচারকে কোন অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। অর্থাৎ, ব্যভিচার তাদের আইনে কোন অপরাধ নয়। তাদের আইন অবশ্য তাদের কালচারের সাথে বিসদৃশ নয়। কিন্তু আমাদের দেশে শুধুমাত্র পুরুষকে আইনের আওতায় আনা এবং নারীকে দায়মুক্ত করা আমাদের কালচার, সংবিধান উভয়ের সাথে বিসদৃশ।
Discussion about this post