আইন কি?
এমন আতর্কিক প্রশ্ন দেখে সহজ মনে হলেও কঠিনও নয়, বরং অদ্ভুত, রোমাঞ্চকর একটি ব্যাপার সামনে আসে। আইন পড়া শুরু করতে গেলে আমরা যেভাবে আইন পড়ি তেমন একটা উদাহরণ দেওয়া যায়।
এইতো কিছু কাগজে কয়েকটি ধারা, উপধারা, অনুচ্ছেদ, দফা’র মাধ্যমে কিছু বাক্যে কিছু লেখা। সেই আইন নিয়ে বেঁচে থাকলেও হয়ে যায়। কিন্তু, পৃথিবীর কোর যেমন কোমল, তরল, উপরে কঠিন; ঠিক তেমনি আইন কি সেই জানার দিকে ছুটতে গেলে দেখা যাবে এমন এক কঠিন-তরলের গোলকধাঁধা।
আইন আসলেই বা কি? ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কেউ কিছু লিখল বা লিখলোও না, সবাই মানলো বা মেনে নিতে বাধ্য হল। এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রথম পদক্ষেপ হল এই “কেউ” এর সন্ধান করা। এই “কেউ” কেনই বা আইন তৈরী করল? কেন তাকে আইন তৈরী করতে হল?
আপনার যদি মনে এই প্রশ্নগুলো উঠে আসে তাহলে একদম শুরু থেকেই জানার চেষ্টা করা উচিত।”‘আইন’, ‘কানুন’, ‘ আদালত’, ‘ইনসাফ’— এই শব্দগুলো আট শ’ বছর আগে আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল না। আইন-কানুন— এই দ্বিপদী শব্দ আইন শ্রেণীবাচক বা আইনের বহুবচন হিসেবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে।

‘আইন’ ফার্সি শব্দ। ‘কানুন’ আরবি, গ্রিক ‘কানুন’– এর সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। ‘অ্যাক্ট’, ‘ইক্যুটি’, ‘রুল’, ‘রেগুলেশান’ শব্দগুলোর ব্যবহার আড়াই শ’ বছরেরও কম। তুরস্কদের আগমনের পূর্বে ইনসাফ-ইক্যুটি বলতে ‘ধর্ম’ শব্দের ব্যবহার হত। এই অর্থাঢ়্য শব্দে ছিল মানুষের অশেষ বিশ্বাস, ভরসা ও প্রত্যাশা।
তাই আজও অন্যায় হলে লোকে বলে, ‘ধর্ম হলো না’। অন্যায় করলে লোকে বলে, ‘ধর্ম করলেন না’। বিচার চাইলে লোকে বলে, ‘ধর্ম করুন’। যাঞ্চায়, ভিক্ষায় বা অনুযোগে ধর্মের দোহাই দেওয়া হয়।
সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বিশ্বাস, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সংকল্প গ্রহণে হিন্দু সমাজে ধর্ম সাক্ষী করে স্থাপিত ঘট স্পর্শ করার যে রেওয়াজ তারই অনুসরণে ধর্মঘটের আজ, নিয়মিত ও অনিয়মিত, ব্যাপক প্রচলন, ইংরেজি ‘স্ট্রাইক’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে। যেখানে বিচার হয় সেই বিচারালয়কে ধর্মাধিকরণ বলা হয় এবং যিনি বিচার করেন, তিনি ধর্মাবতার।
এখনও কাঠগড়ায় স্ব স্ব ধর্মের নামে শপথ করে সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়।” [আইনবিষয়ক প্রবন্ধাবলী, লেখক– মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান]
“আমরা শুধু জানি আইন আছে। কিন্তু তা আমরা দেখতে পাই না। পড়া যায়, অনুভব করা যায়, মানেও পাওয়া যায় হয়তো ছাড়া ছাড়া, কিন্তু বোঝা যায় না। তবে একটা বিষয় পরিস্কার। আসলে যার যার পক্ষপাত বা স্বার্থপরতা তার আইনের ধারণাকে আকার দেয়।” [আইনের ভাব ও অভাব, লেখক– ড. এস. এম. মাসুম বিল্লাহ।]
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “আইন” অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি।
“আমরা ফুটপাতে গাড়ি চালাতে পারবো না” ;“আমরা প্রতিবেশীর গাড়ী চুরি করতে পারবো না” ;দিনে কতবার আমাদেরকে কে বলবে কি করতে হয়, কি করতে হয় না? আমরা যা চাই তা করতে আমাদের কতবার থামতে হয়? কারণ, আমরা জানি কোন কাজগুলো আইনি আর কোনগুলো বেআইনি।
সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের কাছে সবকিছু তদারকি করবার জন্য কতগুলো আইন এবং নিয়ম রয়েছে। যদিও আমরা সবসময় এই নিয়মগুলো মেনে চলতে পছন্দ করি না। যার কারণ, এই আইনগুলো প্রায়ইশ এমন এক অর্থে দাঁড়ায় যা আমরা করতে চাই তা থেকে বিরত রাখে।
আইন এমন কিছু নিয়মের সমষ্টি যা একটি সম্প্রদায়ের সমস্ত লোকদের আবদ্ধ করে। আইনের এই বিধানগুলোই আমাদের সাধারণ অধিকারগুলোকে সুরক্ষিত রাখে এবং অন্যান্য ব্যক্তি, সংস্থা এবং সরকার কর্তৃক অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার নিশ্চিত করে।
“Law is a body of rules, whether formally enacted or customary, which a state or community recognizes as binding on its members or subjects. It may also be said that, Law is a body of rules which are enforceable in a court of law.” [Law and Legal English, Barrister Abdul Halim & Farhana Helal Mehtab]
অধ্যাপক হল্যাণ্ড (Prof. Holland) -এর মতে – “Law is a general rule of external human action enforced by a sovereign political authority.” অর্থাৎ, আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণের নিয়ন্ত্রনবিধি যা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবৎ করা হয়।
“আর্নল্ড তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “আপোলোজিয়া ফর জুরিসপ্রুডেন্স –এ লেখেন, আইনবিজ্ঞান হলো ন্যায় দ্বারা পৃথিবী শাসিত হবে। এমন একটি চকচকে অথচ অপূর্ণ স্বপ্নের নাম। কারও কারও কাছে একটি এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে সুপ্ত রয়েছে, যার বিস্তারিত তাদের জানা নেই।
আর যারা এর আদ্যপান্ত বিষয়ে খবর রাখেন তাদের কাছে এটি না পড়া একটা সাহিত্যের গভীড়ে লুকিয়ে আছে। আর এ সাহিত্য সম্পর্কে যারা ওয়াকেবহাল আছেন তাদের কাছে এটি ভবিষত্যের বাত্তি-জ্বালানির আকাঙ্ক্ষার মধ্যে গ্রোথিত আছে। আর সবার কাছে এটি আছে ঠিক আশেপাশেই।” [আইনের ভাব ও অভাব, লেখক– ড. এস. এম. মাসুম বিল্লাহ।]
কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য ও সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য কিছু নীতি ও বিধি অনুসরণীয়। আইনের গুরুত্ব একটি সমাজে তখনই বুঝা যায় যখন সেই সমাজে দাঙ্গা, অশান্তি এবং অপশক্তি বিদ্যমান থাকে। এবং তখনই মানুষ বুঝতে পারে সমাজ নির্বিঘ্নে এবং শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য আইনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় কতটা।
President Theodore Roosevelt once said, “Ours is a government of liberty, by, through and under the law. No man is above it, and no man is below it.”
ইতিহাসের পাতায় মত-পার্থক্যজনিত কারণে মানব জাতিগুলোর মধ্যে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মাঝে অনেক যুদ্ধই হয়তো সংঘটিত হতো না যদি তারা শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা করতো এবং একে-অপরের সাথে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সুনির্দিষ্ট আইনের অবতারণা করতো। এখানেই আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট।
রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ ও বেআইনি নির্যাতন এবং নিজেদের তৈরি নৈতিক আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার জন্য এক নতুন রাষ্ট্র নির্মাণে সুবিপুল আয়োজন এবং নজিরবিহীন বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালে।
এই আন্দোলনের মূখ্য উদ্দেশ্যই আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনাতে বর্ণনা করা হয়েছে— “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;”
আইন মানুষের প্রয়োজনেই তৈরী, মানুষ হওয়ার জন্যই তৈরী, মানুষের এই বিশাল কলেবরের খেলাধুলায় আইন একটি টুল মাত্র। এই দাবায় ন্যায় বিচার হয়, অবিচারও হয়। ন্যায়ের জন্যে লড়ে যাওয়াই হোক মানবধর্মের প্রথম শপথ।

দি প্রোফেট এর লেখক কাহলিল জিবরান এর কথা দিয়ে শেষ করছি— “তাদের সম্পর্কে বা আমি কি বলবো যারা রোদে এসে দাঁড়ায় কিন্তু সূর্যের দিকে পিঠ দেয়? তারা শুধু নিজেদের ছায়া দেখে, আর তাদের ছায়া গুলো হচ্ছে তাদের আইন। আর সূর্য তাদের কাছে প্রচ্ছায়া দাতা ছাড়া কি?
আর আইনের বিধান মানার অর্থ নিচু হয়ে ঝুঁকে মাটির বুকে ওই প্রচ্ছায়া গুলি আঁকা ছাড়া আর কিছু কি? কিন্তু তোমরা যারা সূর্যের পানে মুখ করে হেঁটে চল মাটির বুকে আঁকা কোন প্রতিমা তোমাদের ধরে রাখতে সক্ষম হবে?”
পরিশেষে, আমাদের মহান স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে যথোপযুক্ত জনমানসের আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
Discussion about this post