মোঃ আল-ইমরান খান:
পরিকল্পনাহীন জীবন মাঝিবিহীন নৌকার মত; সঠিক পরিকল্পনাই কেবল পারে কাউকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দিতে, তাই পরিকল্পনা মাফিক জীবন চলবে- এটাই সবার প্রত্যাশা থাকবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখা যায়, আমরা লক্ষ্যহীন ভাবে হাঁটতে থাকি এবং বলি- “ যা করে আল্লায়, কাউকে তো দেখিনি জীবনে থেমে থাকতে”। কথার মধ্যে ভূল নেই কিন্তু এ মন্তব্য নেহাত দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল মাত্র আর কিছুই নয়। আল্লাহ পাককে স্মরণ করা আর নিজের ভূল ত্রূটির দায় তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া এককথা নয়। আইন একটি মহৎ পেশা। অনেকের স্বপ্ন থাকে জীবনে বড় ও সফল আইনজীবী হবেন; কেউবা স্বপ্ন দেখেন সৎ বিচারক হবেন যাকে লোকজন শ্রদ্ধার সাথে তার জীবদ্দশায় তো বটেই মরণের পরও স্মরণ করবে। বয়সে নবীন হলেও ভাল বিষয় নিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিৎ। আমাদের উচিৎ মানুষকে সফল হিসাবে দেখতে চাওয়া; নিজেও সফল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। সফলতা শুধু পেশাগত উৎকর্ষতার মধ্য দিয়েই নয় বরং একজন মানুষ হিসাবে, পরিবারের- সমাজের ভাল একজন সদস্য হিসাবে। যাই হোক, আইনের ক্ষেত্রে সফলতার মূলে পরিকল্পনাকে আমার বিবেচনায় তিনটি ক্যাটাগরিতে রাখা যেতে পারে-
১) দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা;
২) মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা;
৩) স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা।
দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা
দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হল তাই যেখানে মানুষ অভিষ্ঠ লক্ষ্য হিসাবে জীবনের কোন এক পর্যায়ে পৌঁছাতে চায়। উল্লেখ্য, বাই-চান্স আইনজীবী হওয়া আর পরিকল্পিত উপায়ে সেটা গ্রহণ করা-এই দুয়ের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। যাইহোক,পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সবাইকে চূড়ান্ত লক্ষ্য-কে সামনে ধরে এগুনো উচিৎ। পেশাদারিত্বের প্রশ্ন হিসাবে, আমরা জীবনে যা-ই করবো না কেন আমাদের কল্পনায় থাকবে আমাদের সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য…. ব্যক্তিগত জীবনে আমার এমন কিছু বন্ধু হয়েছে যারা সবসময় আইন নিয়ে চিন্তা করেন। অনেক ভাল ভাল চাকুরী ও অন্যান্য সুযোগ থাকা সত্বেও তারা আইনের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে থাকেন সর্বসময় উদগ্রীব। আমি জানি একদিন তারা বড় হবেন; দেশের আইন জগতে তাদের এক সময় এক নামে খুজে পাওয়া যাবে। ৩০-৪০ বছর পরের কথা চিন্তা করুন, চিন্তা করুন তখন আপনি আপনাকে কোথায় দেখতে চান। ধরুন তখন আপনি, আপনি দেশ বরেণ্য আইনজীবী ও একজন সংসদ সদস্য হতে চান। এ লক্ষ্যে আপনার যা দরকার তা হল, ভাল সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করা। আদর্শ নির্ভর কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকুন। নিবেদিত প্রাণে কাজ করুন। মানুষের উপকারে কাজ করুন। সবার কাছে আপনাকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরশীল একজন ব্যক্তিতে পরিণত করুন। আবার ধরুন, আপনি আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষাবিদ হতে চান সে ক্ষেত্রে আপনি আইনের মৌলিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করুন। সেগুলো দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক জার্ণালে প্রকাশের ব্যাবস্থা করুন। দেশের বাইরেও লিয়াজো রাখার চেষ্টা করুন। এগুলো সবই সম্ভব। আর সফল ও মেধাবী আইনজীবী হতে গেলে নিয়মিত আইনী বিষয় গুলোর চর্চা করা, ব্যাপক পড়াশুনা করা সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্যান্য দেশে, অন্যান্য দেশের উচ্চ আদালত সমূহে কি নজীর রয়েছে সেগুলো জানার চেষ্টা করুন। সফল আইনজীবী এক দিনের সৃষ্টি নয়। দীর্ঘ দিনের অধ্যবসায়, ভাল সিনিয়য়ের সান্নিধ্য পাওয়া, আইন সহ জ্ঞান- বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় দখল থাকা অপরিহার্য। মনের মধ্য স্বপ্ন রাখুন, সেই অনুপাতে কাজ করুন, সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থণা করুন- সফল আপনি হবেনই।
মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা
মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা মূলতঃ দীর্ঘ মেয়াদী আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার জন্য অগ্রগতি মূলত সফলতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ও বিজয় অর্জন করার জন্য ক্ষেত্র সৃষ্টির নামান্তর। ধরুন, আপনি ৩০-৪০ বছর পর দেশ বরেণ্য এমন এক আইন শিক্ষায় পাথেয় হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে চান যেখানে আপনার চিন্তার উপর ভিত্তি করে দেশের আইন প্রণেতাগত মানুষের ব্রত সাধনে আইন প্রণয়ণ করবেন-এটা আপনার দীর্ঘ মেয়াদী চিন্তা। কিন্তু ৪০ বছর পর সেটা নিজে-নিজে আপনার কাছে ধরা দিবে না। এ লক্ষ্যে আপনার চিন্তা গুলোকে প্রকাশ করার চেষ্টা করুন। ২০ বছরের মধ্যে আপনার চিন্তা দেশের তৎকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতন মহলের নজরে আনার চেষ্টা করুন। আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য হিসাবে প্রামণের জন্য মধ্য মেয়াদী এই ২০ বছর আমার বিবেচনায় বেশ ভাল একটা সময়। কেননা আপনার ভেতরে আইনের কি জ্ঞান আছে সেটা আপনি প্রাকটিসে যাবার পর পরই আপনার পাশের চেম্বার থেকে শুরু হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাবে। সারা বারে এই সুনাম ছড়িয়ে পড়ার জন্য ২০ বছর যথেষ্ট সময়।
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা
স্বল্প মেয়াদ পরিকল্পনা আমাদের সফলতার জন্য সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ। আপনি ভবিষ্যতে কি করতে চান, কি হবেন-এটার অনেকাংশ আপনার আজকের কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে। যদিও ভাগ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তার পরেও আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান সবচে’ বড় ন্যায় বিচারক; কারো পরিশ্রম ব্যর্থ করে তাকে হতাশ করবেন এমনটা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। আমাদের দৃষ্টি বাহ্যিক আমাদের সীমাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে না যেখানে সর্বশক্তিমান ভূত- ভবিষ্যত সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। যাই হোক, আইনে সফলতার জন্য আমাদের উচিৎ প্রতিদিন সফল হওয়া। আমাদের ক্লাশে সফল হওয়া, আমাদের দেশে এবং দেশের বাইরে সফল হওয়া সর্বত্র সফল হওয়া বা এটার জন্য চেষ্টা করা। আমরা কয়েকবার ব্যর্থ হতে পারি কিন্তু আমাদের হতাশ হলে চলবে না।আপনি যদি সফল আইনজীবী বা ভাল আইনের শিক্ষক বা বিচারক হতে চান তাহলে আজ থেকেই কিছু বিষয় যেমন- উত্তম বাগ্মীতা, চিন্তার প্রখরতা, ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের গুনার্জন ইত্যাদি বিষয় আপনার নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করুন। আরেকটি বিষয় আইন আর রাজনীতি এই দুইটি একই সূত্রে গাথা। বিশ্ব রাজনীতিতে ভাল রাজনীতিবিদ বলতে আমরা ভাল আইনজীবীকে অনেক ক্ষেত্রে বুঝিয়ে থাকি।
ছাত্র জীবনকে জীবনের সোনালী সময় বলা হয়, সুতরাং এই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের উচিৎ সঠিক উপায়ে কাজে লাগানো। বাইরের বিষয় বাদ দিয়ে শুধু বইয়ের পাতায় মুখ গুজে রাখা যেমন অনুচিত তেমনি পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুধু বাইরে সময় দিয়ে পড়াশোনাটাকে পার্ট-টাইম হিসাবে গ্রহণ করাও অনাকাংখিত। ঢাকার বাইরে থেকে যারা পড়াশোনার জন্য ঢাকা সহ নিজ এলাকার বাইরে আসেন তারা প্রায়শঃই বিপথগামী হয়ে থাকেন যা আপনার বাবা-মায়ের সাথে বেঈমানির নামান্তর। মোদ্দা কথা, আপনি যদি ভাল জ্ঞানী হন, পরিশ্রমী হন, আইন ভালবাসেন- এটাকে সাধনা হিসাবে গ্রহণ করেন- সফলতা আপনি পাবেনই। আপনার নিজ দক্ষতা আপনাকে অন্য ব্যক্তি থেকে আলাদা করে দিবে; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফুলঝুরি দিয়ে অন্যরা আপনাকে বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারবে না, যদিও আপনি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কি শিখলেন এটা কিছু কছু সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, আপনি মানে শুধু আপনি নন- আপনি মানে আপনার বাবা-মা, প্রতিবেশি, আপনার দেশের আপামর গরিব মেহনতি মানুষ- এনাদের সবার প্রত্যাশা আপনার কাজের সাথে জড়িত। আপনি যখন নিজে সফল হবেন সেই সঙ্গে সফল হবে উল্লেখিত ব্যক্তিগন। সফল হবে আপনার আমার এই অভাগা দেশও। প্রশ্ন করতে পারেন- এত কথা বললাম ব্যক্তিগত ভাবে আমি কি সফল- উত্তরঃ সফল হবার চেষ্টা করছি এটা দীর্ঘ মেয়াদী পক্রিয়া তবে আমি সুখি ও অল্পে তুষ্ট।
Discussion about this post