অ্যাড.এম.মাফতুন আহমেদ
উদাসী মন। এক পলকে ভাবুক হৃদয়ে পৃথিবীর অনেক কিছুকে ভাবিয়ে তোলে। মাঝে মধ্যে ঘরে-বাইরে,বন্ধু-বান্ধবদের দু’নয়নে চোখ বুলিয়ে দেখার ইচ্ছে করে। এদের মধ্যে অনেকের হঠাৎ কী আপডেট? কী অভাবনীয় পরিবর্তন? আর আমরা! পশ্চাৎপদ নাঙ্গা-ভূখা মানুষদের মধ্যে আজও একজন। হঠাৎ দু’দিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন।
মাঝে মধ্যে স্বদেশী সাজতে যেয়ে প্রগতির নামে ধোঁয়া তুলে সব কিছু ভুলে যায়। এদের ঘরে বাবা চেনে না ছেলেকে,মা চেনে না মেয়েকে। পরস্পর কার কি মর্যাদা বা সম্পর্ক তাও জানে না।
পরস্পরের মধ্যে সামাজিক বন্ধন কী তাও জানে না। বেহায়া আর নিলজ্জতা কাকে বলে। সবই আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। বাবা দেখছেন ছেলেকে নিয়ে ইন্ডিয়ান ‘এস.আর্ট’ বা ‘ক্রাইম পেট্রোল’।
পরিণতিতে ছেলে এসব দেখে হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী। ‘ষ্টার জলসা’ দেখে বা ফেস বুক ঘেটে ঘেটে মা-মেয়ে পরস্পর ভিন্ন পুরুষের সাথে পরকীকায় মেতে উঠছে। এক পর্যায়ে ঘর ছাড়ছে। নগ্নভাবে জীবন-যাপন করছে।
বর্বর বিজাতীয় সভ্যতাকে আলিঙ্গন করছে। এরাই এদেশের ভদ্রলোক! আভিজাত্যের হঠাৎ ফেরিওয়ালা। অহং-এ গদগদ। এরাই বাবাকে পাপা বলে। মাকে ড্যাডি বলে। এরা জেগে জেগে ঘুমায়। এদের ঘুম কে ভাঙ্গাবে? কোন মরদে মমিন বলবে খামোশ! বন্ধ করো এক্ষুণি এসব বিজাতীয় অপ-সংস্কৃতি।
মনে রাখতে হবে,জাতিতে বাংলাদেশী। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে স্ব-স্ব ধর্মানুরাগী। স্ব-স্ব ধর্মীয় অনুশাসনে বিশ্বাসী। এই তল্লাটের মানুষগুলো ধর্মীয় অনুশাসনকে সব সময় গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পরস্পর স্বীয় কৃষ্টি সভ্যতায় বেড়ে উঠেছে।
এখানে কেউ হিন্দু,কেউ মুসলমান,কেউ বৌদ্ধ,কেউ খৃস্টান,আবার নানা শ্রেণির উপ-জাতির বসবাস। পরস্পর তাঁরা স্বীয় ধর্মানুরাগী। এদেশের জনগণ ধর্মীয় সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করেন। তেমনি শত শত বছরের গড়ে উঠা বনেদী সামাজিক শিষ্টাচারকে মান্য করেন।
তাই আজও পরস্পর যুগ যুগ ধরে সামাজিক রীতি-নীতি সমূহ অনুকরণ করে চলেন। এটাই হলো এদেশের আবহমান সংস্কৃতি। বলতে পারেন বাঙালি সংস্কৃতি।
এক সময় মুসলমান ঘরের ছেলেরা জন্মদাতা পিতাকে আদর করে ডাকতেন ‘আব্বা,আব্বাজান,আব্বাজী,বাপজান,বাপ’। হিন্দুরা আজও পিতাকে শ্রদ্ধাভরে ‘বাবা’ বলে ডাকেন। যদিও বাবা ফার্সি শব্দ। এখন কেন এক শ্রেণির মুসলমান ঘরের ছেলেরা পিতাকে Daddy,Papa, আম্মাকে Mummy বলে? একবার ভেবে দেখুন তো ড্যাডি,প্যাপার আভিধানিক অর্থ কী? এসব কী বাঙালি সংস্কৃতি,না ইসলামি সংস্কৃতি?
ড্যাডি,প্যাপা,মাম্মি ইংরেজি শব্দ। যার অর্থ বাবা। মাম্মি অর্থ-মাকে সম্বোধন করা। এক কথায় ইহুদি-খৃষ্টানরা তাঁদের পিতা-মাতাকে এভাবে সম্বোধন করে থাকে।
বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। কোন মুসলমান ইহুদি-নাছরা তথা বিধর্মীদের আদর্শকে অনুকরণ করতে পারেন না। খৃষ্টানদের অনুকরনে মুসলমান ঘরের সন্তানরা তাদের পিতা-মাতাকে Daddy,Papa, Mummy বলতে পারেন না? ইহুদী-খৃষ্টানরা তাদের সন্তানকে ‘আব্বা,আব্বাজান,আব্বাজী,বাপজান,বাপ’ বলে কী ডাকেন? তাহলে অবলীলায় আমরা কেন তাদের অনুকরণ করছি?
এ সবের সূদূরপ্রসারি রহস্য কী? ভেবে দেখেছেন কারা এই শ্যামল বাংলার শত শত বছরের বনেদি সামাজিক ব্যবস্থাকে মিচমার করতে চাচ্ছেন? কারা একটি আদর্শভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বিপরীত ইহুদী,খৃষ্টান,হিন্দুত্ববাদের দর্শন চাপিয়ে দেবার পায়তারা করছেন?
কারা মরদে মমিন মুসলমানের মুখ থেকে পবিত্র আল-কুরআনের বাণী কেড়ে নিতে যাচ্ছেন। কারা গগণ বিদারি শ্লোগান ‘নারাই তাকবির,আল্লাহ আকবর’ এ সু-মধুর ললিত কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছেন? এসব এখনই ভেবে দেখা প্রয়োজন। সাবধান! সময় ফুরিয়ে গেলে সাধন হবে না।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসুলে কারিম (স.) মাধ্যমে তামাম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন পবিত্র ‘আল-কুরআন’। তাই আল-কুরআন একটি শ্বাশত বিধান। এই বিধানের আলোকে মুসলমানরা হাজার হাজার বছর ধরে সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে আসছেন।
পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানে ইসলামের ছায়া পড়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে একটি আদর্শ ভিত্তিক বনেদি সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ইহুদী-খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিশ্বময় শান্তির এই ম্যাসেসটি মেনে নিতে নারাজ।
সারা পৃথিবীময় ইসলামের পুনঃজাগরণকে কাফের,মুশরেক,মুনাফিক ও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসীরা সহজে মেনে নিতে পারেননি। তাই তাদের বশংবদ ইহুদী-খৃষ্টানরা ইসলামি দুনিয়ায় একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাঁরা পরিবার প্রথাকে ভেঙ্গে দিয়ে নারীদের ঘরের বাইরে বের করেছে। তাদেরকে নিয়ে সম-অধিকারের দাবি তুলেছে।
তারা অপসংস্কৃতি হিসেবে মাদক,বেলেল্লাপনা,দেহ ব্যবসা,লিভ টুগেদার,সমকাম ও সমলিঙ্গ বিবাহকে সরকারিভাবে আইন সিদ্ধ করেছে। ইসলাম ধ্বংসে দীর্ঘ মেয়াদি এক এক সেক্টরে ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে।
বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত ধর্মীয় অনুশাসনে বিশ্বাসী একটি দেশ। তাঁরা স্বীয় ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে তাঁরা কেউ ধর্মান্ধ নয়। অন্য ধর্মের প্রতি বৈরি নয়;বরং পরস্পর সম্প্রতির বন্ধনে আবদ্ধ। তাঁরা জানে এই স্বাধীন তল্লাটে দেশপ্রেমিক সিরাজের যেমন বংশধর রয়েছে তেমনি মীরজাফর বা লেন্দুপ দর্জির সংখ্যা নেহাত কম নয়।
তাঁরা বুঝেছে একটি চেয়ার বা পদবীর জন্য স্বাধীনতাকে তারা অন্যের কাছে বিকিয়ে দিতে পারে। অর্থের কাছে ধর্মান্তরিত হতে পারে। স্বীয় ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। ঘরে ঘরে সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙ্গেচুরে মিচমার করে দিতে পারে। তাই তাঁরা এই মাটির পালস্ বুঝে-শুনে কিছু মনগড়া কনসেপ্ট তৈরি করে। যা অপসংস্কৃতি। যা স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষ্টি সভ্যতার বিরুদ্ধ মাত্র।
অতঃপর এ সব বস্তাপচা মতবাদ বাজারে ছেড়ে দেয়। এক শ্রেণির উচ্ছেষ্টভোজী ফেরিওয়ালারা হট কেকের মত পাশ্চত্যের এসব অপসংস্কৃতি লুফে নেয়। এক কথায় তারা আবহমান এদেশের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ধীরে ধীরে উঠতি বয়সী প্রগতির নামধারী সোনার ছেলেরা এ দলে ভিড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বিদেশী সংস্কৃতিকে তাঁরা লালন করে।
আভিজাত্যের হালকা ছোয়া লাগে। অতঃপর বোতল ভরে হুস্ককি টানে। নামি-দামি হোটের রেস্তোরায় আনন্দ ফর্তি করে। এরা বাংলার কোকিল কণ্ঠ ভুলে গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস করে। আভিজাত্যের ভড়ং-এ মা-বাবাকে
ড্যাডি,প্যাপা,মাম্মি বলে ডাকে। এরা দু’দিনের বৈরাগী ভাতকে অন্ন বলে ডাকে। আসলে তারা জেগে জেগে ঘুমায়। জানে না ড্যাডি,প্যাপা,মাম্মি ইহুদি-খৃস্টানদের ভাষা। উঠতি বয়সের সোনা মনিদের বিদেশী সংস্কৃতি একবার ধরিয়ে দিতে পারলে তারা এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
রাষ্ট্রীক স্বাধীনতা দূর্বল হয়ে পড়বে। একদিন দেখা যাবে ইসলামী জোসে আকৃষ্ট এই বাংলার মুসলমানদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবার আবদ্ধ করে ফেলবে।
স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মরদে মমিনকে মনে রাখতে হবে একটি জাতি যখন অপর একটি জাতিকে রাজনৈতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে,তখন বিজয়ী জাতি বিজিত জাতিকে সংস্কৃতিক দাসত্বের জিঞ্জিরেও আবদ্ধ করতে চায়। কারণ,বিজয়ী জাতি ভাল করেই জানে যে,বিজিত জাতি যে কোন সময় রাজনৈতিক শৃঙ্খল ছিন্ন করতে পারে।
সুতরাং এই জাতির মন মানসকে বিজয়ী জাতির প্রতি অনুগত রাখার একমাত্র ব্যবস্থা হলো বিজিত জাতিকে তাদের সংস্কৃতি থেকে দুরে সরিয়ে বিজয়ী জাতির সংস্কৃতি দ্বারা যুক্ত করা।
ইংরেজরা এই উপমহাদেশে এই কাজ ঠিকই করে গিয়েছিল। এ জন্য তাদের রাজনীতির জোয়াল আমাদের ঘাড়ে এখন না থাকলেও সংস্কৃতির জোয়ারটা শক্তভাবে ঠিকই আছে। এই দাসত্বের জোয়াল কম-বেশি প্রায় সকলের ঘাড়েই চেপে আছে। যার পরিণতি আগামীর জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ।
তাই আপনার ঘরে ঘরে ইহুদী-খৃষ্টানদের ভাষা ড্যাডি,প্যাপা,মাম্মি বর্জন করুন। আপনার শিশুকে আজই ইসলামি কৃষ্টি সভ্যতা তথা বাঙালি সংস্কৃতির অনুকরনে দিক্ষা দানে এগিয়ে আসুন। আর তাদেরকে ড্যাডি,প্যাপা,মাম্মি এসব কথা না শিখিয়ে সু-মধুর কণ্ঠে বলতে বলুন ‘আব্বা,আব্বাজান,আব্বাজী,বাপজান,বাপ,বাবা’ বলে ডাকতে।
একটি রাষ্ট্রের অভিন্ন ভাষা ঐক্যতা স্থাপনে এবং পরস্পর জাতীয়তাবোধ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কেন পাশ্চত্য সভ্যতা আমরা অনুকরণ করবো। তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। তারা সেই ভাষায় কথা বলে। আমরা কেন তাদের পদাংক অনুসরণ করবো।
এই ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচ্য প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয়। মোগল শাসনে মুঘল সম্রাট আকবর একবার তার দরবারে পন্তডিতদের আমন্ত্রণ জানালেন ভাষা মানুষ কীভাবে রপ্ত করে তা জানতে। উপস্থিত পন্ডিতগণ বললেন ভাষা ঐশ্বরিকভাবে মানুষ শেখে।
পণ্ডিতগণ এর পক্ষে বহু যুক্তি দেন। কিন্তু তিনি পণ্ডিতদের কোন যুুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজে একটি পরীক্ষার আয়োজন করলেন। এ লক্ষ্যে তিনি সদ্য জন্মলাভকারী দুটি নবজাতককে একটি দ্বীপে নির্বাসনে পাঠালেন। যাদের এদের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন, তাদের প্রতি নির্দেশনা দেন যেন এই নবজাতক দু’টি কোনভাবেই ভাষার সংস্পর্শ না পায়।
রাজাজ্ঞা বলে কথা। শূলে চড়ার ভয়ে ভীত রাজকর্মচারীরা রাজার নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করলেন। এভাবে চার বছর অতিμান্ত হওয়ার পর তাদের রাজ দরবারে নিয়ে আসা হয়। দেখা গেল নবজাতক দুটি কোন কথাই বলতে পারে না। অতঃপর তাদের কিছুদিন রাজদরবারে রাখা হলে দেখা গেল আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করেছে।
এর অর্থ তারা যখন মানুষের মুখে কথা শুনেছে তখনই সেটি রপ্ত করছে এবং পরে তাই বলতে শুরু করেছে। পরিবারের সদস্যরা যা প্রতিনিয়ত বলে একজন শিশু সেভাবে শেখে। কিন্তু আজ পরিবারে আমরা ইংলিশ ষ্টাইলে সব কিছু অনুকরণ করছি।
পারিবারিক পরিবেশে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা যেভাবে বানের মত প্রবেশ করছে সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। একদিন দেখা যাবে বাংলাদেশ নামটি শুধু থাকবে। নামে বাঙালি থাকবে। লাল সবুজের পতাকাটি থাকবে। কিন্তু বাংলা ভাষার অস্থিত্ব থাকবে না।
আর ভাষা না থাকলে একটি জাতি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে না। কারণ অভিন্ন ভাষা জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
Discussion about this post