যখন কোনো ব্যক্তি কোনো প্রতিকার দাবি করে, তখন তার অধিকারের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হয়। সে কারণে ১৮৭২ সালে উদ্ভব হয় সাক্ষ্য আইনের। একটি মামলার ক্ষেত্রে যেমন পুলিশের বিশেষ ভূমিকা আছে, তেমনি চিকিৎসকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
একটি মামলায় চিকিৎসকের সাক্ষ্য এবং সুরতহাল রিপোর্ট মামলার মোড়কেই ঘুরিয়ে দেয়। ডাক্তারের অবহেলায় যেমন একজন রোগীর জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়, তেমনি ডাক্তারের সাক্ষ্য ও সুরতহাল রিপোর্টও মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫০৯ ধারা মতে ডাক্তাররা (চিকিৎসক) আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। খুন, ধর্ষণের মামলায় ডাক্তারের রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুর কারণ কিংবা ধর্ষণ নিরূপণের জন্যই ডাক্তারি পরীক্ষার প্রয়োজন। ডাক্তারি রিপোর্টের পরও তাকে আদালতে সাক্ষী হিসেবেও তলব করা হয়ে থাকে।
তবে তিনটি কারণে ডাক্তারের সাক্ষ্য ছাড়া ময়না তদন্তের কিংবা ধর্ষণের রিপোর্টটি সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কারণগুলো হলো:
(ক) যে ডাক্তার রিপোর্ট করেছেন তিনি যদি মৃত হন।
(খ) তিনি যদি সাক্ষ্য দিতে অক্ষম হন।
(গ) তিনি যদি বাংলাদেশের বাইরে থাকেন এবং তাকে বিলম্ব, অতিরিক্ত ব্যয় ছাড়া হাজির করা যায় না যা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তিসঙ্গত নয়। (৩৭ ডিএল আর ১৫৬; ৬বিএল ডি ৩৪; ৪ বিসিআর ২০৪)।
ডাক্তারের সাক্ষ্যগত মূল্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে যাতে করে ডাক্তার কোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে অশুদ্ধ ও অসঙ্গতিপূর্ণ কোন রিপোর্ট তৈরি না করেন। উদাহরণ হিসেবে ৩৬ ডিএলআর ১৫১ এডি’র সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি বিচারাধীন কোনো মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, তাহলে সে আইনের চোখে অপরাধী। এ ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড হতে পারে। জরিমানাও হতে পারে।
১৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় এবং এই বিষয়টি বিচারক বুঝতে পারেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
আর যদি ওই সাক্ষ্যের কারণে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তাহলে সাক্ষীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন আদালত।
১৯৫ ধারায় বলা আছে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে কোনো ব্যক্তির যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী যাবজ্জীবন অথবা সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
পাঠক, নিশ্চয়ই পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কনরাড মারির কথা আপনাদের মনে আছে। সংবাদটি সেসময় গোটা যুক্তরাষ্ট্রে তথা সারা পৃথিবীতে আলোচনার ঝড় উঠেছিল। ছয় সপ্তাহ শুনানি চলার পর যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসের আদালত ৭ নভেম্বর ২০১১ তারিখে যখন রায় প্রদান করেন, তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই রায়ের পর ডা. কনরাড মারিকে (৫৮) হাতকড়া পড়িয়ে আদালত থেকে কারাগারে নেয়া হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে বাইরে অপেক্ষমাণ জ্যাকসনভক্তরা তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ আবেগে কেঁদেও ফেলেন।
তবে সরকার কর্তৃক নিয়োজিত রাসায়নিক পরীক্ষক, সহকারি রাসায়নিক পরীক্ষক, রক্ত পরীক্ষক, হস্তলিপি বিশেষজ্ঞ, অঙ্গুলাঙ্ক বিশারদ অথবা আগ্নেয়াস্ত্র বিশারদদের এই কার্যবিধি অনুযায়ী কোনো কার্যক্রম চলাকালীন কোনো বিষয়ে পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করিয়ে রিপোর্ট দিতে হলে তাকে তাকে আদালতে তলব না করেই কথিত দলিল সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে।
রাসায়নিক পরীক্ষকের রিপোর্টও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসায়নিক পরীক্ষকের সাক্ষ্যমূল্য সামান্য, যদি না তার পরীক্ষিত বস্তুর পরিচয় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পরিপত্রে ধর্ষণ কিংবা এসিড বা এ জাতীয় অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ডাক্তারী পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধান কার্যকর করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পুলিশের রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ এবং অন্যান্য সহিংসতার শিকার কোনো নারী ও শিশু যে কোনো সরকারি স্থাপনায় কিংবা সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করবেন এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও নিকটস্থ থানায় প্রেরণ করাসহ, যাকে পরীক্ষা করবেন তাকেও ১ কপি প্রদান করবেন। চিকিৎসক ও তার ক্লিনিক্যাল সহকারীরা নির্যাতনের নারী বা শিশুকে যথাসাধ্য সেবা দেবেন।’
কিন্তু উপরে উল্লিখিত ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয়, এ নির্দেশনা মোটেই অনুসৃত হচ্ছে না। প্রথমত, নির্যাতনের শিকার কেউ হাসপাতালে গেলে থানার রেফারেন্স ছাড়া কর্তব্যরত ডাক্তার মেডিকেল পরীক্ষা করতে রাজি হন না। দ্বিতীয়ত, যাকে পরীক্ষা করছেন তাকেও মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি কোনো অবস্থাতেই সরবরাহ করা হয় না।
এর কোনো কারণই সুস্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত, জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ছাড়া উপজেলা বা আর কোথাও এই পরীক্ষা করা হয় না।
তবে ‘নির্যাতনের শিকার বা তার পরিবারে কারও হাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান করা কেন সম্ভব নয়- এ ধরণের প্রশ্নে ডাক্তারদের স্পষ্ট জবাব ‘আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?’ অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট জেনে গেলে, তিনি ধরে নিচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবেন। তাহলে কে বা কারা এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, সেটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।
কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩২ ধারায় ষ্পষ্ট বলা আছে যে, ধর্ষিতা নারী ও শিশুর মেডিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ষণ সংঘটিত হবার পর যথাশীঘ্র সম্ভব তা সম্পন্ন করতে হবে এবং যথাশীঘ্র মেডিক্যাল পরীক্ষা না করলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া আইন আরও বলছে, মেডিকোলিগ্যাল দায়িত্ব পালন করতে পারেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় কর্মকর্তা, জেলা হাসপাতালের আরএমও এবং মেডিকেল অফিসার ও নির্দিষ্ট কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করার যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার উপজেলা পর্যায়ে তো আছেই, এমনি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে। উপজেলা পর্যায়ে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার উপকরণও আছে। সুতরাং এ জাতীয় পরীক্ষা উপজেলা হাসপাতাল থেকে করে সার্টিফিকেট দিতে আইন বাধা তো নেই-ই, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে দেশের সরকারি চিকিৎসালয়গুলোতে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অন্যান্য ছুটির দিন এবং কর্মদিবসগুলোতে দুপুর ২টার পর কোনো চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যায় না, মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা তো দূরের কথা।
গ্রাম পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে দূরত্ব, যানবাহন, অর্থ সংকট ইত্যাদি কারণে এবং বহুদূর থেকে জেলা সদরে এসে হাসপাতালে ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার কারণে ডাক্তারী পরীক্ষা সময়মতো একেবারেই সম্ভব হয় না। ফলে স্বভাবতই নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধ উৎসাহিত হয়।
আমরা আশা করতে চাই, আইন, নীতিমালা, নির্দেশনা, অবকাঠামো ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে ডাক্তার, পুলিশ সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন।
লেখক আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও পিএইচ.ডি গবেষক।
Discussion about this post