নিজস্ব প্রতিবেদক: মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাস চেয়ে করা আপিলের এই রায় এদিন সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকার এক নম্বরে ছিল।
বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। অন্য বিচারপতিরা হলেন- হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান।
প্রায় পাঁচ বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তিন অভিযোগে এটিএম আজহারের মৃত্যুদণ্ড এবং দুই অভিযোগে মোট ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আপিলে আসা এটি অষ্টম মামলা, যার ওপর চূড়ান্ত রায় হলো।
নিয়ম অনুযায়ী আসামি এই রায় পর্যালোচনার আবেদন করতে পারবেন। তাতে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত না বদলালে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। তাতেও তিনি বিফল হলে সরকার সাজা কার্যকরের পদক্ষেপ নেবে।
২০১২ সালের ২২ অগাস্ট একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মগবাজারের বাসা থেকে আজহারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ১২ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার। বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে রায় ঘোষণার সময় তিনি ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ষাটোর্ধ এই জামায়াত নেতা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, এটা ফরমায়েশি রায়। আমি নির্দোষ। আল্লাহর আদালতে আপনাদের বিচার হবে ইনশাল্লাহ।
আর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল তাদের রায়ে বলেছিল, যে ঘৃণ্য অপরাধ আজহারুল ইসলাম করেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজায় তার সুবিচার হয় না।
এ মামলার দ্বিতীয় অভিযোগে রংপুরের বদরগঞ্জ থানার মোকসেদপুর গ্রামে গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা, তৃতীয় অভিযোগে বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিলের আশেপাশের গ্রামে এক হাজার চারশর বেশি হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি চালিয়ে হত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে আজাহারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া।
এছাড়া রংপুর শহর এবং আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য নারীকে ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতনে সহযোগিতার দায়ে তখনকার এই বদর নেতাকে দেওয়া হয় ২৫ বছরের কারাদণ্ড।
এ মামলার প্রথম সাক্ষী ছিলেন একজন বীরাঙ্গনা, যাকে আরও অনেকে নারীর মত টাউন হলে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আজহার ও পাকিস্তানি বাহিনী, করা হয়েছিল ধর্ষণ। তার জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।
তবে আইনে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা না থাকায় ট্রাইব্যুনাল এ মামলায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণের আদেশ দেয়নি। তার বদলে রাষ্ট্রকে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে বলা হয় রায়ে।
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের ত্যাগ ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে। যাতে বীরঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, পাকিস্তান দখলদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর ও আল শামসের যৌন সন্ত্রাসসহ বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তারা জানতে পারে।
সেই রায়ে বলা হয়, আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচিৎ আর দেরি না করে এই বীরাঙ্গনাসহ সকল বীরাঙ্গনাকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা। কারণ তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এবং সম্মানিত বীরাঙ্গনা। সমাজে তাদেরকে গ্রহণ, স্বীকৃতি এবং সম্মানিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও জাতির অহঙ্কার।
২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। এরপর আদালতের এই পর্যবেক্ষণ এলে ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি মেলে।
আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের সাতটি রায়ের মধ্যে ছয়টিতে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদনেও তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
Discussion about this post