ডেস্ক রিপোর্ট
সপ্তাহে দু-এক দিন ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন, সম্মানী হতে পারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে চিকিৎসক সমাজে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ।
নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে নিজ কর্মস্থলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন (ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস) সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। আগামী মার্চ থেকে ২০টি জেলা হাসপাতাল এবং পাঁচটি মেডিকেল কলেজে এ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া কী হবে— এসবের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে চিকিৎসক সমাজে। বিষয়টি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত ‘আইওয়াশ’ মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জেলা-উপজেলা সরকারি হাসপাতালগুলোতে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয় না। ফলে রোগীদের বাধ্য হয়ে যেতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। এছাড়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকটে প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবার বেহাল অবস্থা। লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ওষুধের দাম।
অন্যদিকে, রাজধানীসহ সারাদেশে লাগামহীনভাবে রোগীদের পকেট কাটছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। এত সমস্যায় যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন সমস্যা সমাধানে কার্যকর তেমন কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই চিকিৎসকদের লাগাম টানছে সরকার— বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন। তবে প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে হতে পারে দু-এক দিন। এক্ষেত্রে রোগী দেখার জন্য আলাদা সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা হবে। চিকিৎসকের মান অনুযায়ী এ সম্মানী হতে পারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা।
একজন রোগী যখন কোনো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যান, চিকিৎসকরা তখন রোগ নির্ণয়ে প্রথমেই আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও রক্ত পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা দেন। অথচ দেশের জেলা-উপজেলা সদর হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ এই সেবাবিহীন অবস্থায় চলছে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ জেলা এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি ৮৯ শতাংশ উপজেলা এবং ৫৬ শতাংশ জেলাতে আলট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা নেই। ইসিজি পরীক্ষা নেই ১২ শতাংশ জেলা এবং ২৪ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে। এছাড়া ৪১ দশমিক ২ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা থাকলেও বাকি ৫৯ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে নেই রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা।
বিএসএমএমইউয়ের গবেষণা আরও বলছে, জেলা হাসপাতালগুলোতে শতকরা ৩০ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৬৩ ভাগ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৭৭ ভাগ জুনিয়র/ সিনিয়র কনসালটেন্টের পদ শূন্য। এছাড়া জেলা হাসপাতালে শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৩৮ ভাগ মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য।
বিএসএমএমইউয়ের গবেষণা বলছে, জেলা হাসপাতালগুলোতে শতকরা ৩০ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৬৩ ভাগ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৭৭ ভাগ জুনিয়র/ সিনিয়র কনসালটেন্টের পদ শূন্য। এছাড়া জেলা হাসপাতালে শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৩৮ ভাগ মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য
গবেষণায় শুধু চিকিৎসক পদই নয়, নার্সিং স্টাফ/মিডওয়াইফ পদের ক্ষেত্রেও জেলা হাসপাতালে শতভাগ ১৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ২৫ ভাগ পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৪২ ভাগ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট/টেকনিশিয়ান পদ শূন্য। সেখানে নেই পর্যাপ্ত ক্লিনার, নিরাপত্তাপ্রহরীও।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আবদুস সবুর খান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় এত সমস্যা, কিন্তু সবকিছু রেখে মন্ত্রী এটি কেন করতে চাইলেন আমার বুঝে আসছে না। আমার যতটুকু ধারণা, ঢাকার দু-চারটি হাসপাতালে কোনোরকম শুরু করে একটু আইওয়াশ করবে। এর বাইরে কিছু না। শুরু হওয়া দু-একটি হাসপাতালের পেছনে যদি আপনারা কিছুদিন লেগে থাকেন তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসবে।
তিনি আরো বলেন, সরকার যদি সিদ্ধান্ত নিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টা প্যাথলজি খোলা থাকবে, এতে বরং রোগীরা বেশি উপকৃত হতেন। কারণ, একজন চিকিৎসক রোগী থেকে কত টাকা ফি নেন, তার চেয়ে তিন/চার গুণ টাকা তো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনেই রোগীদের খরচ করতে হয়।
আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ লাগামছাড়া। এক পরীক্ষাতেই একেক প্রাইভেট হাসপাতালের খরচ একেক রকম। সে জায়গাগুলোতে রোগীদের পকেট কাটা হচ্ছে। চিকিৎসকদের পেছনে না লেগে সেই জায়গাগুলোতে হাত দিলে রোগীদের জন্য ভালো হতো।
‘মন্ত্রী যেভাবে বললেন, ১ মার্চ থেকে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস শুরু হবে, কিন্তু কোথায় কোথায় শুরু হবে সেটি স্পষ্ট করে বলেননি। গল্পগুলো বলতে যতটুকু না ভালো লাগে, বাস্তব প্রয়োগ খুবই কঠিন’— যোগ করেন এ বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, আমি জানি না সরকার আসলে কী চাচ্ছে বা তারা এটাকে কীভাবে অর্গানাইজ করবে? আমাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসায় অনেক অব্যবস্থাপনা আছে। এসবের সমাধান জনগণও চান, চিকিৎসকরাও চান। সরকার এ এজেন্ডা এখন নিয়ে আসছে কেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো গত চার বছর ধরে মন্ত্রী হিসেবে আছেন, আগে কেন চেষ্টাটা করেননি? তবুও আমি মন্দের ভালো হিসেবে বলব, তারা একটা চিন্তা অন্তত করেছে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান প্রয়োজন।
আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় এত সমস্যা, কিন্তু সবকিছু রেখে মন্ত্রী এটি কেন করতে চাইলেন আমার বুঝে আসছে না। আমার যতটুকু ধারণা, ঢাকার দু-চারটি হাসপাতালে কোনোরকম শুরু করে একটু আইওয়াশ করবে। এর বাইরে কিছু না। শুরু হওয়া দু-একটি হাসপাতালের পেছনে যদি আপনারা কিছুদিন লেগে থাকেন তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসবে
তিনি আরো বলেন, এখন একটা পরিপত্র দিয়েই যদি চিকিৎসাটা করা যেত, তাহলেই খুব খুশি হতাম। কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব কি না, জানি না। কারণ, একেকটা হাসপাতালে যত স্পেশালিস্ট আছেন, তাদের বসার জায়গা কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে? এটা তো এমন না যে অহি নাজিল করলাম আর হয়ে গেল। এতে জনগণ আরও আতঙ্কিত হচ্ছেন।
Discussion about this post