বিডি ল নিউজঃ আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, ‘সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আন্দোলন চলছে। আমরা দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। একটি যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে অবতীর্ণ নেতাকর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুলি করে আহত করা, অত্যাচার, নির্যাতন, লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস, পাইকারি গ্রেফতার, পুলিশি রিমান্ড, বাড়িতে হামলার মতো ভয়ঙ্কর ত্রাসের রাজত্বের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রবল বাধা ও অত্যাচারের মুখেও যখন যেখানে সম্ভব হচ্ছে, মিছিল ও প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন তারা। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, ‘জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে মুষ্টিমেয় স্তাবক ও সুবিধাভোগীদের দ্বারা বেষ্টিত সরকার জনগণের আন্দোলনে ভীত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ সব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণভার দলবাজ ও বিতর্কিত কতিপয় কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে তাদের মাধ্যমে জনগণ ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, গত ৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩৩ জন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গুলি করে ও অন্যান্য পন্থায় আহত করা হয়েছে শত শত নেতাকর্মীকে। আটকের পর নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী। ১৭ হাজারের বেশী নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক লাখ। অনেকের বাড়িঘরে গভীর রাতে হানা দিয়ে ভাংচুর, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মহিলাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন ও হেনস্থা করা হচ্ছে। এভাবে সারাদেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণের ওপর এমন চরম জুলুম-অত্যাচারের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আন্দোলনরত বিরোধী দল, জনগণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সকলের মৌলিক-মানবিক সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন ছাড়া প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম পরিচালনাও অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। অফিস বন্ধ করে দেওয়া, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়া, এমনকি দলের পক্ষে কেউ বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করলেই সেই নেতাকে আটক করে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হেনস্থা করা সরকারের নিয়মিত রীতিতে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, অপরদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে শাসক দলের সন্ত্রাসীরা লাঠিসোটা, এমনকি মারণাস্ত্র নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা আমাদের দলের সিনিয়র নেতাদের ওপর গুলি করছে। তাদের গাড়ি, বাড়ি ও অফিসে বোমা হামলা চালাচ্ছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বার বার বলে এসেছি, আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। এ আন্দোলন আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়েই অগ্রসর করে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের আন্দোলন চলাকালে যাত্রীবাহী ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে ইতোমধ্যে নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজন নাগরিকের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই শোচনীয় মৃত্যুর পাশাপাশি বার্ন ইউনিটে ঝলসানো দেহ নিয়ে অনেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। নিরপরাধ মানুষের ওপর এই বীভৎস আক্রমণের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। যারা হতাহত হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। এ সব হীন ও নৃশংস হামলায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি আমরা আগেই জানিয়েছি, আজ আবারও তার পুনরাবৃত্তি করছি।
তিনি বলেন, ‘তবে জীবন-বিনাশী এ সব ঘৃণ্য হামলার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই জনমনে গভীর সন্দেহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ পরিপূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জবরদস্তি করে শাসকগোষ্ঠী কিছু কিছু যানবাহন রাস্তায় নামাচ্ছে। সেই সব যানবাহনে কেমন করে ঘাতক বোমার হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে, তা এক জ্বলন্ত প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, এ সব হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কাউকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি। কোথাও কোথাও বোমা, গুলি, আগ্নেয়াস্ত্রসহ শাসক দলের চেলা-চামুণ্ডারা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে তাদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। অথচ ঘটনার পর পরই বিরোধী দল ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা একতরফা প্রচারণা শুরু করে দিচ্ছে। কোনো তদন্ত ও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আমিসহ বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করছে। কারারুদ্ধ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও এ সব ঘটনায় মামলা হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে সহায়তাকারী অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, এমনকি প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদকে পর্যন্ত বোমাবাজির মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমাদের পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, আমার উপদেষ্টা ও দলের যুগ্ম-মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি পরিষ্কার ভাষায় আবারও বলতে চাই, মানুষের জীবন নিয়ে অপরাজনীতি আমরা করি না। হত্যা ও লাশের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন হীন ও নৃশংস অপরাজনীতি আমরা কখনো করব না। এখন যারা ক্ষমতা আঁকড়ে আছে তারাই অতীতে আন্দোলনের নামে যাত্রীবাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে ডজন ডজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। তারা লগি-বৈঠার তাণ্ডবে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছে। একটার বদলে দশটা লাশ ফেলার প্রকাশ্য নির্দেশ দিয়েছে। অফিসগামী কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য রাজপথে বিবস্ত্র করেছে। সমুদ্রবন্দর অচল করেছে। রেলস্টেশন পুড়িয়ে দিয়েছে। লাগাতার হরতালে এসএসসি পরীক্ষা ৩ মাস পর্যন্ত পিছাতে বাধ্য করেছে। পবিত্র রমজান মাসে পর্যন্ত হরতাল করেছে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদের নামে দিনাজপুরে পুলিশ ব্যারাক জ্বালিয়ে দিয়েছে। তদানীন্তন বিডিআরের পানি সরবরাহের লাইন কেটে দিয়েছে। এখনকার নৃশংস ঘটনাবলীও তাদের অতীত কার্যকলাপের সঙ্গেই মিলে যায়।
খালেদা বলেন, দেশবাসী মনে করেন আন্দোলন দমন ও বিরোধী দলের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়াবার উদ্দেশে শাসক দলই সুপরিকল্পিতভাবে এ সব সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমি এ ধরনের নৃশংস অপরাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানাই।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশবাসী জানেন, সম্প্রতি আমার কনিষ্ঠপুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি মানসিকভাবে এক চরম শোকাবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। এই বিপর্যয়ের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আমার সঙ্গে কী ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা-ও সকলেই দেখছেন। সুপরিকল্পিতভাবে সর্বমুখী চাপ ও অনিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করে তারা আমাকে জনগণ ও নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট। কিন্তু আমি সকলকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, কোনো অনৈতিক চাপ বা ভীতির মুখে আমি নত হব না। যেকোনো পরিস্থিতি বা পরিণতির জন্য আমি তৈরি আছি।’
২০ দলীয় জোট প্রধান বলেন, ‘আওয়ামী শাসকদের একদলীয় ধাঁচের স্বৈরশাসন কায়েমের অপতৎপরতার কারণে অতীতে দেশ জঙ্গিবাদের কবলে পড়েছিল। আমরা তা দমন করেছিলাম। আজ আবার তারা একই কায়দায় উদারনৈতিক রাজনীতির ধারাকে নিশ্চিহ্ন করতে যে চণ্ডনীতি অবলম্বন করছে তাতে আবারও সেই একই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। আমরা এই কঠিন বাস্তবতার দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার হবার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘গত একটি বছর ধরে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ক্রমাগত আহ্বান জানিয়েছি। তারা কোনো কিছুতে কর্ণপাত করেনি। বরং সীমাহীন অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়ে গেছে। অবৈধভাবে করায়ত্ত করা রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে তারা কোনো রকম সমঝোতায় রাজি হয়নি। এমনকি নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের কথা তারা স্বীকার করতেও রাজী নয়। তারা মনে করে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পথেই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে দেওয়া সম্ভব। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আন্দোলন ছাড়া দেশবাসীর সামনে আর কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। তাই ক্ষমতার জন্য নয়, গণতন্ত্র, দেশবাসীর ভোটাধিকার ও হৃত মৌলিক মানবিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে, শান্তি, নিরাপত্তা, আইনের শাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করতে আমাদের এ আন্দোলন অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতে থাকবে।’
Discussion about this post