এস এইচ সৈকত, বিডি ল নিউজঃ কুলাউড়ার হাজীপুরে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীর হাতে একই শ্রেণির অপর ছাত্রী খুন হয়েছে। সোনার কানের দুল ও গলার চেইন কাল হলো হাজীপুরের কোমলমতি ছাত্রী লাবনী আক্তারের (৯)। তার সহপাঠী আফিয়া বেগম (৯) তা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় লাবনীকে ধানৰেতের কাদায় চুবিয়ে হত্যা করেছে। পুলিশ ওই ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়ে ঘাতক সহপাঠীসহ তার এক বোন ও মা-বাবাকে আটক করেছে।
লাবনীর পরিচয়ঃ হাজীপুর ইউনিয়নের সাধনপুর গ্রামের দুবাই প্রবাসী নজরুল ইসলাম ও গৃহিণী রোকেয়া বেগমের মেয়ে লাবনী আক্তার। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে বড় লাবনী। সে স্থানীয় হরিচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। সহপাঠী পার্শ্ববর্তী উত্তর পালকী গ্রামের আফিয়া। বয়সে তার তিন বছরের বড়। সে দুবার ফেল করে তৃতীয় শ্রেণিতেই রয়ে গেছে।
স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাঃ সরেজমিন জানা যায়, গত ২২ অক্টোবর সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু হয়। টিফিনের এক ফাঁকে আফিয়া পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কাঁচা তেঁতুলের প্রলোভন দেখিয়ে স্কুল থেকে আধা কিলোমিটার দূরের পলকি নদীর তীরে নিঝুম ধানক্ষেতের আড়ালে নিয়ে যায় লাবনীকে। সেখানে পৌঁছে আফিয়া লাবনীর কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বর্ণের কানের দুল ও গলার চেইন ছিনিয়ে নেয়। এ সময় দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি শুরু হলে আফিয়া লাবনীর গালে ও কানে সজোরে চড় দিলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। একসময় লাবনীর গলায় ধাক্কা দিয়ে ধানি জমির কাদা মাটিতে চুবিয়ে হত্যা করে কাদামাখা শরীর নিয়ে আফিয়া আবার স্কুলে ফিরে যায়।
আফিয়াকে নিয়ে স্কুলে হইচইঃ নিহত লাবনীর শ্রেণিশিক্ষক ও সহপাঠী সূত্রে জানা যায়, টিফিনের পর যথারীতি ক্লাস শুরু হয়। একজন শিক্ষিকা পাঠদান করছেন, কিন্তু শিক্ষার্থীরা অমনোযোগী। সবাই বাইরের দিকে তাকিয়ে হইচই করছে। শিক্ষিকা তাদের সঙ্গে দৃষ্টি মেলাতেই বুঝতে পারলেন আফিয়াকে দেখে শিক্ষার্থীদের চোখ ছানাবড়া। আফিয়ার সমস্ত শরীর কাদামাখা। কাদায় জলে জুবুথবু হয়ে সে ক্লাসে ঢুকছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ধানি জমির খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। ক্লাসের হইচই কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্যস্ত হয়ে যান পাঠদানে শিক্ষিকা।
ছুটির ঘণ্টাঃ বিকেল ৪টায় বেজে ওঠে ছুটির ঘণ্টা। যে যার মতো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। লাবনী নেই। শুধু তার বই পড়ে আছে ডেস্কে। স্কুল কর্তৃপক্ষ লাবনীর বইটি আরেক শিক্ষার্থীকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
খোঁজ পড়ল লাবনীরঃ স্কুল থেকে পাঠানো টিফিন বক্স ও বই যখন মায়ের হাতে পৌঁছায় মা রোকেয়া বেগম সহপাঠী হালিমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমার মেয়ে কোথায়? হালিমা নিরুত্তর। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি বাকি নেই। মায়ের চোখ জলে ছলছল করছে। শুরু করলেন মেয়ের খোঁজ নিতে। বুকফাটা আর্তনাদ। চারদিকে শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। স্থানীয় মসজিদের মাইকে নিখোঁজ সংবাদটি ভেসে উঠতেই জনপদ জুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ল।
ক্লুর সূত্রপাতঃ সন্ধ্যা মিলিয়ে যাচ্ছে। স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী ফারজানা স্থানীয় লোকদের জানায়, বাড়ির পুকুরঘাটে গোসলের সময় সে দেখেছে টিফিনের ফাঁকে আফিয়া লাবনীকে নিয়ে ধানক্ষেতের আল দিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে সে গোসল শেষে ঘরে ফিরে যায়।
৮ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস সময়ঃ বিকেল ৪টা থেকে রাত আড়াইটা। রুদ্ধশ্বাস সময় কেটেছে তিন গ্রামের মানুষের। সাধনপুর, উত্তর পলকী ও কাউকাপন গ্রামের মানুষের নির্ঘুম রাত কেটেছে। পুকুরে পুকুরে ফেলা হচ্ছে জাল। বিলে- ঝিলে হাজার বাতি, টর্চলাইটের আলো দিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কোথাও সন্ধান নেই। একপর্যায়ে সহপাঠী আফিয়াকে টার্গেট করে লাবনীর খোঁজ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। একপর্যায়ে সে জানাল
কালো করে এক লোক লাবনীকে ধরে নিয়ে গেছে। শতাধিক গ্রামবাসীকে নিয়ে সে নিঝুম ধানক্ষেতের আল দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সে বলে উঠে ওই পথ দিয়ে লোকটি তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে প্রাণে বাঁচলেও
লাবনী প্রাণে বাঁচতে পারেনি। তার অসংলগ্ন কথাবার্তায় নিখোঁজ হওয়া সহপাঠীর খোঁজ মিলছে না।
জুতা দেখে সূত্র আবিষ্কারঃ রাত সোয়া দুইটা। পালকী নদীর তীরবর্তী একটি জায়গায় রাস্তার ওপর লাবনীর পরিহিত টিয়া রঙের একটি জুতা পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই সূত্র ধরে গ্রামবাসী আফিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তারপর প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামবাসী আফিয়াকে নিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন আলপথ দিয়ে হেঁটে ছোট ছোট পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে কর্দমাক্ত ধানি জমির মাঝখানে পৌঁছালেই আফিয়া চিৎকার দিয়ে কাদায় লুটিয়ে পড়ে। এর ঠিক সামনেই টর্চের আলো নিক্ষিপ্ত হয় ধানের ঝোপে কাদাজলে মাখা লাবনীর কোমল মুখমণ্ডলের ওপর। এভাবেই আবিষ্কার হয় কোমলমতি এ শিক্ষার্থীর নিথর দেহ। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ভোরবেলায় থানায় নিয়ে আসে। এ সময় আফিয়া ও তার বাবা তজম্মুল আলী, মা মইরুন বেগম ও ছোট বোন সাফিয়াকে আটক করে পুলিশ।
থানায় মামলাঃ এ ঘটনায় কোমলমতি শিক্ষার্থী নিহতের চাচা মোঃ শাহিন মিয়া কুলাউড়া থানায়
একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
স্তব্ধ সাধনপুর ও উত্তর পলকী গ্রামঃ গত ২৩ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, শোকে কাতর এ দুটো গ্রাম। এতই নীরবতা যে, পাখির কলরবও বন্ধ হয়ে গেছে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ঘটনায় মাতম করছেন। লাবনীর বাড়িজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কান্নার রোল উঠেছে ঘরের টিনের চালা ভেদ করে। স্বজনদের আহাজারি চৌপাশের বাতাস ভারী করে তুলেছে। এতক্ষণে খুন হওয়া শিক্ষার্থীর বাবা নজরুল ইসলাম খবর পেয়ে তিনি দ্রুত দেশে ফিরছেন।
বাবার সঙ্গে মেয়ের শেষ কথাঃ ঘটনার এক দিন আগে, অর্থাৎ ২১ অক্টোবর রাত ৮টায় বাবার সঙ্গে মেয়ের শেষ কথা হয়। বাবা মেয়েকে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছ? ঠিকমতো পড়াশোনা করতেছ? খাওয়া দাওয়া করতেছ? তখন বাবাকে মেয়ে বলে, বাবা আমি ভালো আছি। আমি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবে। সামনে আমার পরীক্ষা।
বাবার কাঁধে মেয়ের লাশঃ গত ২৪ অক্টোবর শুক্রবার। সুদূর দুবাই থেকে শোকে পাথর হয়ে সাধনপুর গ্রাম স্পর্শ করলেন লাবনীর বাবা নজরুল ইসলাম। মৌলভীবাজার পৌরসভার মরচ্যুয়ারিতে রাখা লাবনীর মরদেহ সকাল ৯টায় নিজ বাড়িতে পৌঁছাতেই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মেয়ের মুখমণ্ডল দেখে প্রবাসী বাবা মাথা চাপড়ে বিলাপ করতে শুরু করেন। তিনি বারবার মূর্ছা যান। একই অবস্থা হয় মা রোকেয়া বেগমের। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমার এ অবুঝ মেয়েকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করা হয়েছে। আফিয়া একা আমার মেয়েকে খুন করতে পারে না। এ হত্যাকাণ্ডে আরো লোকজন জড়িত আছে। বেলা ১১টায় সব
মায়া উপেক্ষা করে শিশুতোষ গল্পের উঠোন পেরিয়ে বাবার কাঁধে চড়ে লাবনী চলে যায় বহু দূরে কোথাও, যেখান থেকে আর ফেরা হয় না।
জানাজাঃ গত ২৪ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ১১টায় লাবনীর নিজ স্কুল হরিচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যে মাঠে এখনো এক্কা-দুক্কা খেলার পদচিহ্ন রয়ে গেছে। মাঠজুড়ে নেমেছিল শত শত শোকার্ত মানুষের ঢল।
ছোট্ট কবরে চিরনিদ্রায় শায়িতঃ জানাজা শেষে স্থানীয় গোরস্থানের ছোট্ট কবরে শায়িত হলো মা-বাবার প্রাণের
টুকরো লাবনী আক্তার। চটপটে পুতুল পুতুল চেহারায় যে মেয়েটি দিনমান আনন্দে পুরো ঘরকে মাথায় তুলে রাখত, আজ সে ঘর শোকে মুহ্যমান। উবে গেছে সকল আনন্দ-হাসি।
আফিয়ার সরল স্বীকারোক্তিঃ থানায় আটক আফিয়া জানায়, আমি থাপ্পড় মেরে লাবনীকে মেরে ফেলেছি। তেঁতুল
নিয়ে ঝগড়া করে একপর্যায়ে লাবনীকে চড় বসিয়ে দিই। এ সময় সে ধানক্ষেতের ঝোপে কাদায় লুটিয়ে পড়ে। তার নিষ্প্রাণ দেহ দেখে আমি পালিয়ে যাই।
এলাকাবাসীর বক্তব্যঃ এলাকাবাসীর ধারণা, স্বর্ণের কানের দুল ও গলার চেইন কাল হয়েছে লাবনীর। এগুলো ছিনিয়ে নিতে আফিয়া শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সজাগ থাকলে হয়তো এ ঘটনা ঘটত না। কোন শিক্ষার্থী কোথায় গেল ক্লাস করছে কি না,সে বিষয়ে তাদের খেয়াল রাখা উচিত ছিল। পাঁচ গ্রামের ১টি স্কুল হরিচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। সাত শিক্ষকের মধ্যে একজন ডেপুটেশনে,দুই দিনের মাথায় আরো দুই শিক্ষক ছুটি নিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক কী করে দুজনকে ছুটি দিলেন? সে বিষয়ে এলাকার অভিভাবকমহলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা জানান, চার শিক্ষক কীভাবে এত শিক্ষার্থীকে সামাল দেবেন। এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জের বক্তব্যঃ কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ অমল কুমার ধর জানান, জোর তদন্ত চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, সহপাঠী আফিয়াই লাবনীকে হত্যা করেছে।
তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট এলে আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে।
Discussion about this post