নির্দিষ্ট ভূখন্ডবাসী প্রতিটি নাগরিকের রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাধিকার সাম্যতা এবং শাসনতান্ত্রিক অভিন্ন অবদানের মানবীয় বোধই বর্তমান পরিশীলিত গণতন্ত্র। খৃষ্টিয় দিন-পঞ্জিকার গণনা শুরুর পূর্বে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পন্থা প্রথম রাষ্ট্র পরিচালনায় অবতারণা করেছিল গ্রিক-রোমানরা যদিও সে সময়ে নারী এবং দাসেরা যেহেতু নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারনি সেক্ষেত্রে তা ডেমো গণতন্ত্র বা অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র বলা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বের জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশই কিন্তু গণতান্ত্রিক মতাদর্শে পরিচালিত যদিও অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ তার গণতন্ত্র এখন বইটিতে উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া ব্যতীত বিশ্বের গণতন্ত্রের পথাবলম্বী সবকটি দেশ এমনকি গণতন্ত্রের বিপনি বিতান আমেরিকার গণতন্ত্রের অবস্থা ভালো নয় বলে স্বীকার করে গেছেন। কিংবা গণতান্ত্রিক মোড়কীকরণ রাজনীতি মাত্র বাস্তবতা ভিন্ন পন্থানুসরণ করে।
সামন্তবাদী শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ নাগরিকের যেমন ছিল প্রশাসনে সামিল হওয়ার প্রতিবন্ধকতা ঠিক তেমনি ছিল রাষ্ট্রের নিয়মনীতির গ্যাড়াকলে পড়ে নিষ্পেষিত হওয়ার মধ্যযুগীয় সুযোগ। শুরু হয় অধিকার আদায়ের আন্দোলন, সাহিত্যের কলমে গাইয়ে বাজিয়ের কন্ঠে হার্মোনিয়ামে ওঠে সাম্যের সুর, রাষ্ট্র চালনায় সকলের অংশগ্রহণের চাই অবাধ অধিকার চাই গণতন্ত্রের শাসন চাই আপামর জনসাধারণের শাসন। উপনিবেশীক প্রভাব নিপিড়ন থেকে গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদ, পৃথিবীর বুক কলঙ্কিত হয় বিশ্বযুদ্ধের কলঙ্কে। গণতন্ত্র চাই তখন বিশ্ব দরবারের সকল রাষ্ট্রের সমান অধিকার নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, সে বোধ থেকে অকার্যকর লিগ অফ ন্যাশন বর্তমান ইউনাইটেড ন্যাশনস বা জাতিসংঘ।
কিন্তু নির্বাচনের গণতন্ত্র অভ্যন্তরিণ রাজনীতিতে আসে আপন সত্তাকে বিষর্জন দিয়ে প্রতিশ্রুতির আড়ালে। জমি নেই জমি দেবে, পানি নেই পানি দেব, শিক্ষা নেই স্কুল দেব কলেজ দেব, চাকরি নেই চাকরি দেব। নেতা যেন নেতা নয় সে যেন গণতান্ত্রিক মুদিখানার বিশ্বস্ত ব্যপারী। যেন এগুলো সব তার গুদামঘরে রাখা রয়েছে নেতা বনে গেলেই একটি একটি করে বের করে জনগণকে দেয়া হবে। ভুলে যায় গণতন্ত্র কথাটির সাথে মানুষের জন্মগত অধিকার জড়িত।
গণতন্ত্র পরিভাষাটি ইংরেজি শব্দ ডেমোক্রেসি থেকে এসেছে যার উৎপত্তি গ্রিক শব্দ দেমোক্রাতিয়া থেকে যার অর্থ জনগণের শাসন, শব্দটির দুইটি মূল হচ্ছে দেমোস অথাৎ জনগণ ও ক্রাতোস অর্থাৎ ক্ষমতা। আব্রাহাম লিঙ্কন তার এক ভাসনের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রের এক জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করেন Government of the people, by the people, for the people.’ যার অর্থ হলো-গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। অধ্যাপক গেটেলের মতে,’ যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।
সংজ্ঞানুযায়ী গণতান্ত্রিক ছিটেফোঁটা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে যেন পরাভূত হয়ত এজন্যই অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ স্যার বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন, কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের শাসন নয়, এক্ষেত্রে আইনের প্রাধান্যই বড় কথা৷ কিন্তু ব্যক্তি কেন্দ্রীয় লোকরঞ্জনবাদ যেন করে ফেলেছে গণতান্ত্রিক মতাদর্শেকে পরাভূত এবং বিক্রিত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান নিশ্চিত করেছে এদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ৮ম অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সরূপ গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্ণিত আছে যে,
(১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।
এছাড়াও ১১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে৷
পরিশেষে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশকে উন্নিত করতে হলে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি সহ জনগনকেই যেকোনো অগণতান্ত্রিক আচরণ প্রতিহত করার জন্য রুখে দাড়াতে হবে ।
Discussion about this post