ড. বদরুল হাসান কচি
‘আমার পরিচয় আমি মানুষ, আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাকে মালাউন বলবেন না’- দেবু ভট্টাচার্য নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দুইদিন আগে তাঁর ফেইসবুক আইডিতে এমন একটি কথা লিখেছেন। লাইনটি পড়লেই বুঝা যায় কতোটা অসহায়, বিপন্ন আর বিষাদে ভরা মন নিয়ে তিনি এমন একটি কথা বলেছেন। হিন্দুদের মালাউন বলে গালি দেয়া শুরু সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে; পাক সেনারা হিন্দুদের এ নামেই ডাকতেন। মালাউন আরবি শব্দ অর্থাৎ আল্লাহর অভিশপ্তপ্রাপ্ত। স্বাধীন দেশেও কথাটি কম বেশী প্রচলন ছিল ধর্মান্ধ অসাম্প্রদায়িক লোকজনের মুখে। কষ্ট হলেও তারা মেনে নিয়েছে এতদিন; কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের একজন মন্ত্রী যখন মালাউন বলে গালি দেয় তখন তাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্রই তাদের গালি দিচ্ছে এবং পুরো দেশ এই গালি দেয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। একজন মন্ত্রীর এই কথাটি পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিশ্ববাসীর কাছে। কেবল হিন্দু ধর্মের মানুষ হওয়ায় নিজ দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন নিজেকে এতো বিপন্ন বোধ করেন সেখানে অন্য সাধারণ মানুষের মনের কি অবস্থা একবার ভাবুন তো!
কোন ঘটনায় কোন পরিস্থিতিতে একজন মন্ত্রী এই কথাটি উচ্চারণ করেছেন সে ঘটনার ভেতরে খানিকটা যাওয়া প্রয়োজন। ৩০ অক্টোবর রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে একেবারে ঘোষণা দিয়ে এবং প্রস্তুতি নিয়ে অনেকগুলো মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মের শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িতে হামলা হয়েছে, সেগুলো তছনছ করা হয়েছে, লুট করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ নিরপরাধ শতাধিক মানুষের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। মূলত এ ঘটনার দুইদিন আগে অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইসবুকের একটি পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। ফেইসবুকে রসরাজ ‘ইসলাম অবমাননা করে’ পোস্ট দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তাকে শনিবার আটক করে। পরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই ঘটনা নিয়ে রোববার বিক্ষোভ সমাবেশের পর হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাটি সুপরিকল্পিত তা বুঝা যায় এ কারণে যে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে পুলিশ গ্রেফতার করার পরদিন কেন এ ঘটনা ঘটলো?
বলা চলে ৪ বছর আগে কক্সবাজারের রামু বৌদ্ধ মন্দিরে যে ঘটনা ঘটেছে পুরোপুরি সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। আরও একটি আশ্চর্য মিল হল, সব ধর্মের মানুষের জন্য বাসযোগ্য নিরাপদ একটি বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কিছু নেতা কর্মী দুই ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে!
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ঘটনার পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা দেখেছি, আমাদের কোনো গ্যাপ ছিল না।’ অথচ এই বক্তব্যের পরদিন পুনরায় ভোররাতে আরও ৮/১০ টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে বসবাস করা ছাড়া তাদের আর কোনো দোষ নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বাহিনীর কোন গ্যাপ খুঁজে না পেলেও মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে সে গ্যাপ ঠিকই উঠে এসেছে; সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর দূরদর্শিতার অভাব, উদাসীনতা এবং অবহেলা এ হামলার সুযোগ করে দিয়েছে বলে বলা হয়েছে।
ধর্ম নিরপেক্ষতা যে রাষ্ট্রের মূলনীতি সে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠরা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এমন বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করা অনভিপ্রেত। বলা যায় এটা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। রাষ্ট্র তার প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনলাইন কিংবা অফলাইনে যারা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করেছেন বা করছেন তার বেশীরভাগই স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম। অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে একটানা কোন অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাওয়া যায়নি। বরং সামরিক শাসকরা ক্ষমতায় এসে ধর্মকে পুঁজি করে মানুষের অনুভুতি নিয়ে খেলা করেছে। তাই একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের আস্থা বেশী। ফলে সে দলের কোন সদস্য কিংবা জনপ্রতিনিধি যদি সাম্প্রদায়িক আচরণ করে সেক্ষেত্রে সকলেই আঘাত পায় অত্যাধিক। আধুনিক বাংলাদেশ যাদের হাতে গড়ে উঠবে সে প্রজন্মকে শৈশব থেকে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় বেড়ে উঠতে রাষ্ট্রীয় নানানমুখী কর্মপরিকল্পনা এবং উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
সবার মনে যেন এই বিশ্বাস ধারণ করে; মানুষের পরিচয় প্রথমে মানুষ, ধর্ম নয়। এই দেশ মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকলের। দেশের কাছে সকলের সমান সুযোগ, সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার থাকবে। আগামীর বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র হোক।
লেখকঃ সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম।
Discussion about this post