আইনুল ইসলাম বিশাল
সাতক্ষীরা বার এর বিজ্ঞ আইনজীবী মোঃ শাহ আলম স্যারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি আইনাঙ্গনে গত দুই দিন যাবৎ আলোচিত হচ্ছে। মোঃ শাহ আলম স্যার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী অপরাধ করেছেন কিনা?
আইন অনুযায়ী বিজ্ঞ আইনজীবী গ্রেফতার হতে পারেন কিনা? এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিই যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা? দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব নিয়ে আলোচনা হওয়ার পরিবর্তে মামলার বাদী লিয়াকত টাউট কিনা সেটি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে অথবা মামলার বাদী লিয়াকতকে টাউট হিসেবেই উপস্থাপন অথবা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যারা লিয়াকতকে টাউট হিসেবে দাবি করছেন তাদের নিকট প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মামলার বাদী যদি টাউট হয় তাহলে কি তাকে মারধর করে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করা যাবে? আইন অনুযায়ী কি এটা বৈধ? টাউট হলেই কি তার গলায় ” আমি টাউট, আমি আইনজীবী নয় ” লিখে, তার ফটো তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া যাবে?
টাউটের বিষয়ে অথবা টাউটকে আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই উপস্থাপন করতে পারবেন অথবা তার বিষয়ে প্রচার করতে পারবেন? টাউটের বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ কোনো অপরাধ করলে সে কি দায়মুক্ত?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে সকল ধারায় ( ২৫(২) / ২৯(১)/ ৩১(২)/ ৩৫(২)) মামলা করা হয়েছে সেসকল ধারা গুলো দেখলাম সেখানকার একটি ধারায়ও পেলামনা কোনো টাউটের বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ কিছু প্রচার প্রচারণা করলে উক্ত ব্যক্তি দায়মুক্ত থাকবে।
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেউ যদি কোনো টাউটের বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় অপরাধ করে তাহলে কি তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না? টাউটের সাজা কি ধোলাই দিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেওয়া ? আর টাউটকে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে যদি কেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় কোনো অপরাধ সংগঠিত করে তাহলে তার জামিন বা নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার উপায় কি সেই টাউটকে সোস্যাল মিডিয়ায় আরো ভাইরাল করা?
টাউট আইন, ১৮৭৯ এ দেখলাম টাউটের শাস্তি তিন মাস পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা ৫০০ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড। উক্ত আইনে পেলাম না টাউটকে ধোলাই দিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেওয়া টাউটের সাজা। একজন টাউটকে আপনি চাইলেই আঘাত করতে পারেন না, যদি করেন তবে সেটি দন্ডবিধির আওতায় অপরাধ। সোস্যাল মিডিয়ায় যদি তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেন তবে সেটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আরেকটি অপরাধ।
কখনো আইনের শাসন কোনো বেআইনী কর্মকান্ড দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। হয় আইন সংশোধন করে বর্তমানে বলবৎ আইনে শাস্তির যে বিধান আছে সেটি তুলে দিয়ে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করুন টাউটের সাজা ধোলাই দিয়ে ভাইরাল করে দেওয়া অথবা ধোলাই দিয়ে ভাইরাল করার যে চর্চা এখন বিদ্যমান আছে সেটি বন্ধ করে যথাযথভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসুন।
তাহলে সাতক্ষীরার মতো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, যদি তা না হয় তাহলে এমন মামলা, ঘটনা, বিবৃতি, লেখালেখি চলতেই থাকবে তাতে আইন পেশার সম্মান হানি হবে। বিচার ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যাবে। চায়ের আড্ডায় ঝড় উঠবে, ফেসবুকে দেখলাম এডভোকেটরা আরেক এডভোকেটের মুক্তি চেয়ে লেখালেখি করছে।
কোনো এক সহজ সরল জনতা হয়তো কোনো একদিন বিজ্ঞ আইনজীবীদের জিজ্ঞেস করে বসবেন জজ সাহেবরা কি ফেসবুকে আপনাদের পোস্ট দেখে এখন বিচার কার্য পরিচালনা করেন ? যদি এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ হ্যাঁ বলেন তখন তাকে বুঝাতে হবে কিভাবে ফেসবুকের পোস্ট দেখে বিচারকার্য পরিচালিত হয় আর যদি উত্তর না হয় তখন বুঝাতে হবে, তাহলে কেনো ফেসবুকে আপনারা মুক্তি চাচ্ছেন? জামিন চাচ্ছেন?
লিয়াকতের বিষয়ে একটি ভিডিও ফেসবুকে দেখলাম, সে ভিডিওর মাধ্যমে হয়তো বুঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে লিয়াকত একজন টাউট। সেই ভিডিওতে দেখলাম একজন বিজ্ঞ আইনজীবী আদালতে তার বক্তব্য উপস্থাপন করছেন এবং লিয়াকত বিজ্ঞ আইনজীবীর পেছনে দাড়িয়ে আছেন। তার পোশাক বা তার শারিরীক ভাষা কোনো কিছুতেই মনে হয় না সে আইনজীবী হিসেবে নিজেকে বিচারকের সামনে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের উচিত একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী একজন আইনজীবীর সাথে কতটুকু পর্যন্ত আদালতে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে সেটি স্পষ্ট করা।টাউট আইন ১৮৭৯ এর (৩) ধারা অনুযায়ী টাউট বলতে, কোনো আইনজীবীর নিকট থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আইন পেশায় কোনো আইনজীবীর কর্ম সংগ্রহ করে, অথবা কোনো আইনজীবী কিংবা কোনো আইন ব্যবসায় স্বার্থসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আইনজীবীর কর্ম সংগ্রহ করার প্রস্তাব দেয়া অথবা এই উদ্দেশ্যে দেওয়ানি বা ফৌজদারি আদালত, রাজস্ব কার্যালয়, রেলস্টেশন, ঘাট, আশ্রয়স্থান অথবা অন্য কোনো স্থানে আনাগোনা বা ঘোরাঘুরি করা অথবা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করাকে বুঝায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে টাউট আইনের আলোকে লিয়াকতের সেই ভিডিওর মাধ্যমে কি প্রমান হয় অথবা কি প্রমান করা যায়?
আচ্ছা, বিচারকার্য চলাকালীন কেউ কি ভিডিও ধারন করতে পারে? বিচারকার্য ভিডিও ধারন করে কি সোস্যাল মিডিয়ায় দেওয়া যায়? বিচারকার্য ভিডিও ধারন করা এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা কি অপরাধ নাকি অপরাধ নয়? কেউ যদি বিষয়টি সম্পর্কে জানেন তবে আমাদের জানাবেন, আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।
সবশেষে বলবো আদালতে টাউট নিধনের পাশাপাশি নিয়মিত আইনজীবী তালিকাভুক্তির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। হাজার হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবীর জীবন থেকে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে, এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিন। প্যান্ডামিক সিচুয়শনে নিয়মিত কার্যক্রমের মাধ্যমে আইনজীবী তালিকাভুক্তি সম্পন্ন করতে না পারলে বিকল্প ভাবুন।
লিখিত পরীক্ষার পূর্বে বলেছিলেন ফলাফল দুই মাসের মধ্যে প্রকাশ করবেন, আপনারা আপনাদের বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আর বিলম্ব না করে ফলাফল প্রকাশ করুন। যারা প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান আছেন তাদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অনলাইনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করুন। এরমধ্যে দিয়েই আইনের শিক্ষার্থীদের ও আইনাঙ্গনের প্রকৃত কল্যাণ অর্জিত হওয়া সম্ভব।
Discussion about this post