ডিক্রী (Decree)
ডিক্রী বলতে আদালত কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারিত এমন কোন বক্তব্যকে বোঝায়, যা কোন মামলায় তর্কিত সমস্ত বা যে কোন বিষয় সম্পর্কে পক্ষসমূহের অধিকার চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে।
এটা প্রাথমিক বা চূড়ান্ত (Preliminary or Final) হতে পারে। আরজি বাতিল (Rejection of Plaint) এবং অত্র আইনের ১৪৪ ধারায় বর্ণিত কোন প্রশ্ন বিচারে নিষ্পত্তি হলে তাও ডিক্রী হিসাবে গণ্য হবে। তবে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহ ডিক্রীর অন্তর্ভুক্ত হবে না-
- ক) যে সব আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যায়,
খ) আদালতের কোন নির্দেশ পালনে ব্যর্থতার কারণে কোন মামলা খারিজের আদেশ
একটি ডিক্রী তখনই প্রাথমিক হয়, যখন মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য আরও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন থাকে। আর মামলার বিষয়বস্তু যখন চূড়ান্তরূপে নিষ্পত্তি হয়, তখনই ডিক্রী চূড়ান্ত হয়ে থাকে। ডিক্রী আংশিকভাবে প্রাথমিক এবং আংশিকভাবে চূড়ান্তও হতে পারে।
আদেশ (Order)
আদেশ বলতে দেওয়ানী আদালতের এমন কোন সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক প্রকাশকে বুঝায়, যা ডিক্রী নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি তারিখে কোন একটি মামলার শুনানির (Preemptory Hearing) দিন ধার্য হল কিন্তু ঐ তারিখে বাদী অথবা বিবাদী কোন পক্ষই হাজির না হওয়ার কারণে উভয় পক্ষের অনুপস্থিতিতে মামলা ডিসমিসের আদেশ হল। এটা আদালতের একটি আদেশ।
ডিক্রী ও আদেশ এর মধ্যকার পার্থক্য-
- সমস্ত ডিক্রীর বিষয়েই আপীল করা চলে কিন্তু আইনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ না থাকলে কোন আদেশের বিরুদ্ধে আপীল চলে না। কোন কোন আদেশের বিরুদ্ধে আপীল চলে তা অত্র আইনের ১০৪ ধারা এবং ৪৩ অর্ডারের ১ রুলে বর্ণিত আছে।
- কোন কোন ক্ষেত্রে আপীল আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পুনরায় ঊর্ধ্বতন আদালতে দ্বিতীয় আপীলও করা যেতো, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে আদেশের বিরুদ্ধে আপীল চললেও দ্বিতীয় আপীলের কোন বিধান নেই।
- ডিক্রী দ্বারা একটি মামলা পক্ষগণের মধ্যে উত্থাপিত বিচার্য বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় কিন্তু কোন আদেশ দ্বারা তা হয় না।
উদাহরণস্বরূপ, নিঃস্ব ব্যক্তি (Pauper) হিসেবে কেউ যদি আদালতের মাধ্যমে প্রার্থিত প্রতিকার পাওয়ার জন্য দরখাস্ত দেয় আর আদালত যদি সেই দরখাস্ত না মঞ্জুর করেন, তবে তা আদলতের একটি আদেশ। অনুরূপভাবে দরখাস্ত মঞ্জুর হলে এটাও একটি আদেশ। কিন্তু দরখাস্ত মঞ্জুর হওয়ার পর তা আরজি হিসাবে গৃহীত হয়ে মামলার চূড়ান্ত শুনানীর পর আদালত নিঃস্ব বাদীর প্রার্থিত প্রতিকার বিষয়ে যে রায় দেবেন এবং তদনুযায়ী আদালতের যে দলিল প্রস্তুত হবে তা হচ্ছে একটি ডিক্রী।
সম্পর্কিত আরেকটি লেখাঃ
দেওয়ানী আদালতের আদেশ,নিষেধাজ্ঞা,রায় বা ডিক্রি ভঙ্গ করলে করনীয় (ভায়োলেশন কেইস)
রায় (Judgment)
ডিক্রী বা আদেশের ভিত্তি হিসাবে বিচারক যে বিবৃতি দেন তাকে রায় বলা হয়। একটি ডিক্রী বা আদেশের সমর্থনে আদালত যে সকল যুক্তি এবং কারণাদির উপর নির্ভর করেন সেই যুক্তি ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিকে রায় বলা হয়।
মামলার রায় ও ডিক্রী পরস্পরের পরিপূরক
ডিক্রী দ্বারা বিবাদমান পক্ষগণের মধ্যে উত্থাপিত বিচার্য বিষয়ের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। ডিক্রির ভিত্তিমূলে থাকে রায়। একটি ডিক্রির পরে কোন মামলার কি ফলাফল হল তা পাওয়া যাবে সত্য, কিন্তু কেন মামলাটি ডিক্রী অথবা ডিসমিস হল এই কেন প্রশ্নের উত্তর কেন ডিক্রীতে পাওয়া যাবে না। কোন মামলা বিচারে ডিসমিস হলে এই ডিসমিস আদেশ অনুযায়ীও ডিক্রী প্রস্তুত করতে হয়।
যেমন রহিম করিমের বিরুদ্ধে ৩০০/- টাকার দাবীতে একটি মামলা দায়ের করল। করিম মামলায় উপস্থিত জবাব দিল যে তার নিকট রহিমের কোন পাওনা নেই এবং বিচারে আলাদত তাই সাব্যস্ত করে রায় দিলেন। পরবর্তীতে রহিমের মামলাটি খরচসহ ডিসমিস হল। এই অবস্থাতেও মামলার রায় অনুযায়ী ডিক্রী প্রস্তুত করতে হবে। ডিক্রীতে পক্ষদের নাম থাকবে কি বাবদ, কে কার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল তা থাকবে এবং মামলার ফল কি হল তাও থাকবে।
এই ক্ষেত্রে এই প্রকার ডিক্রী হবে যে দু-তরফাসূত্রে রহিমের মামলা করিমের বিরুদ্ধে ডিসমিস হয়। করিম রহিমের নিকট হতে এই মামলায় আইনসঙ্গত খরচ পায় এবং কত খরচ বাবদ পাবে তাও এই ডিক্রীতে উল্লেখ থাকবে। কিন্তু কেন রহিমের মামলাটি করিমের বিরুদ্ধে ডিসমিস হল তার কারণ ডিক্রীতে পাওয়া যাবে না। এই বিষয়ে যাবতীয় কারণাদি পাওয়া যাবে মামলার রায়ে। অতএব একটি মামলা কিভাবে বিচারে নিষ্পত্তি হল তা সম্যকরূপে জানতে হলে ঐ মামলার রায় ও ডিক্রী একসাথে দেখা আবশ্যক।
বিচারক অন্যত্র বদলী
কোন মামলার শুনানি সমাপ্ত হবার পর আদালতকে তৎক্ষণাৎ অথবা পরবর্তী নির্ধারিত তারিখে প্রকাশ্যভাবে মামলার রায় প্রদান করতে হবে। কোন বিচারক রায় লিখে তা ঘোষণা না করে অন্যত্র বদলী হয়ে গেলে তার পরবর্তী বিচারক তা ঘোষণা করতে পারবেন। রায়, ডিক্রী বা আদেশ একবার আদালত কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও ঘোষিত হলে অত:পর কেবলমাত্র ১৫২ ধারা অনুসারে বা রিভিউ করা ব্যতীত এর কোন সংশোধন বা সংযোজন করা চলবে না।
একটি রায়ের গঠন
আদালতের রায়ে মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বিচার্য বিষয়সমূহ, তৎসম্পর্কে আদালতের সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ, বিচার্য বিষয় অনুযায়ী পৃথকভাবে উল্লেখ করতে হবে। যে সকল মামলায় বিভিন্ন বিচার্য বিষয় থাকে, সেই ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিচার্য বিষয় সম্পর্কে আদালতের সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ বিচার্য বিষয় অনুযায়ী পৃথকভাবে উল্লেখ করতে হয়।
তবে অবস্থা যদি এমন হয় যে এক বা একাধিক বিচার্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেই মামলাটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, তবে সকল বিচার্য বিষয়ে পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়েও মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করা যায়। যেমন রহিম করিমের বিরুদ্ধে একটি মামলার জবাব দিলে কয়েকটি বিচার্য বিষয় ধার্য হল। তন্মধ্যে একটি বিচার্য বিষয় ছিল বাদীর মামলা তামাদিতে বারিত। তামাদি বিষয়ে বাদীর মামলা অচল, এই বিষয়ে আদালত যদি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসেন, তবে অন্যান্য বিচার্য বিষয়ে কোন সিদ্ধন্তে না এসেও আদালত বাদীর মামলা ডিসমিস করতে পারেন।
তবে অধিকাংশ ঊর্ধ্বতন আদালত সকল বিচার্য বিষয়ে পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করবার পক্ষপাতী ১৯৮৩ সালের ২০ আদেশের ৫ বিধির সংশোধনের কারণে। এখন সমস্ত বিচার্য বিষয়ে আদালতকে পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন একটি বিচার্য বিষয়ের সিদ্ধান্তের উপর মামলা নিষ্পত্তি করা যাবে না। তবে ছোট মামলার আদালতের (Small Causes Court) রায়ে কেবলমাত্র বিচার্য বিষয়সমূহ ও তৎসম্পর্কে আদালতের সিদ্ধন্তসমূহ উল্লেখ করলেই চলবে।
ডিক্রী প্রস্তুত
রায়ের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে ডিক্রী প্রস্তুত হয়। এতে মামলার নম্বর, পক্ষগণের নাম ও পরিচয় এবং দাবীর বিবারণ উল্লেখ করতে হবে। যে প্রতিকার মঞ্জুর করা হয়েছে তাও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সিদ্ধান্ত স্পষ্টরূপে উল্লেখ করতে হবে। মামলার খরচের পরিমাণ এবং তা কি অনুপাতে কে বহন করবে তারও উল্লেখ থাকবে।
কোন বিচারক রায় ঘোষণা করার পর এবং ডিক্রী প্রস্তুত হবার পূর্বে যদি অন্যত্র বদলী হয়ে যান, তবে তার পরবর্তী আদালত উক্ত রায় অনুসারে প্রণীত স্বাক্ষর করতে পারবেন। মামলার বিষয়বস্তু যদি স্থাবর সম্পত্তি হয় তবে সেই সম্পত্তি সনাক্ত করণের জন্য যাবতীয় তথ্যাদি অর্থাৎ সেটেলমেন্ট পর্চার দাগ, খতিয়ান নং ইত্যাদি ডিক্রীতে উল্লেখ করতে হবে।
Discussion about this post