ডেস্ক রিপোর্ট
নানা আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স চালু রাখার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির এক সভায় সান্ধ্য কোর্স চালু রাখার বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সান্ধ্য কোর্স চালু রাখা হবে কিনা, রাখা হলে সেটি কোন পদ্ধতিতে চলবে—এ বিষয়ে সুপারিশমূলক প্রতিবেদন ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নে বছর দুয়েক আগে উচ্চপর্যায়ের এ কমিটি গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সভা সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু রাখা হলেও এর পরিচালনা পদ্ধতিতে ব্যাপক আকারে পরিবর্তন আনতে চায় কমিটি। এ লক্ষ্যে পরিচালনা পদ্ধতিবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে শিগগিরই তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন কমিটির সদস্যরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিক্ষা অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, সান্ধ্য কোর্স রাখার বিষয়ে কমিটি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এসব কোর্স কোনোভাবেই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালনা করা যাবে না। এ কোর্স রাখার উদ্দেশ্য হবে—স্কিলড প্রফেশনাল তৈরি করা। তাই এর প্রচলিত পদ্ধতিতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে।
কী ধরনের পরিবর্তন আনা হবে?—এমন প্রশ্নের জবাবে দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার এ অধ্যাপক বলেন, আগের মতো যেকোনো বিভাগ তাদের ইচ্ছামতো সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে না। প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে শিক্ষার্থী আসন নির্ধারণ করা হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কারা কতগুলো কোর্স নেবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। এছাড়া আয়-ব্যয়ের বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা থাকবে।
২০০২ সালে দেশে সান্ধ্য কোর্স প্রথা চালু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ। শিক্ষকদের অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ থাকায় খুব দ্রুতই অন্য বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ ধরনের সান্ধ্য কোর্স। দুই দশকের কম সময়ে ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ৬৯টি সান্ধ্য কোর্স চালু করা হয়।
বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হওয়ায় এসব কোর্স নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন ওঠায় ২০১৯ সালে সান্ধ্য কোর্সের যৌক্তিকতা যাচাইয়ে ডিন পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গত বছর সান্ধ্য কোর্স পরিচালন পদ্ধতির বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরে পরিচালনা নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশপূর্বক একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। পাশাপাশি নীতিমালা প্রণয়নের আগ পর্যন্ত সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এ সুপারিশ একাডেমিক কাউন্সিলে উত্থাপিত হলে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্কে লিপ্ত হন শিক্ষকরা।
এরপর সান্ধ্য কোর্সবিষয়ক যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই কমিটিতে দুজন উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সব অনুষদের ডিন ও দুজন ইনস্টিটিউট পরিচালককে সদস্য করা হয়। গত সোমবার এ কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভা বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বণিক বার্তাকে বলেন, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোর্সের ভূমিকা রয়েছে, তাই বন্ধ না করে যুগোপযোগী ও যৌক্তিকভাবে এসব কোর্স পরিচালনার বিষয়ে মতামত এসেছে। এখন কমিটি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সেটি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবে। পরবর্তী সময়ে একাডেমিক কাউন্সিলের বিশেষ সভার মাধ্যমে সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
নীতিমালায় কোন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে?—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে যেহেতু সান্ধ্য কোর্স নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে, তাই আমি এটিকে প্রফেশনাল কোর্সে নামকরণের প্রস্তাব করেছি। এছাড়া এসব কোর্সের আয়ের একটি অংশ ডিন অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে।
সান্ধ্য কোর্স পর্যালোচনা ও যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স আছে। মাস্টার্স, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট, ট্রেনিং কোর্সসহ অনিয়মিত এসব কোর্সের সংখ্যা ৬৯। এর মধ্যে ৫১টি মাস্টার্স, চারটি ডিপ্লোমা, সাতটি সার্টিফিকেট আর সাতটি ট্রেনিং কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের বাইরে ১০৫টি ব্যাচে এসব কোর্সে বছরে ৭ হাজার ৩০২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এসব কোর্সের ক্লাস নেন ৭২৫ জন শিক্ষক। সবচেয়ে বেশি সান্ধ্য কোর্স আছে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। এ অনুষদের নয়টি বিভাগের প্রতিটিতেই চালু আছে সান্ধ্য কোর্স। এসব কোর্সে প্রতি বছর ৪৫টি ব্যাচে ২ হাজার ৯৬৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। ক্লাস নেন ২৩০ জন শিক্ষক।
যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির প্রতিবেদনেও প্রচলিত পরিচালনা পদ্ধতি সংস্কারে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, সান্ধ্য কোর্স চালু করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের নিজস্ব সামর্থ্য (শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা, ভৌত অবকাঠামো, লাইব্রেরি ও আনুষঙ্গিক বিষয়) বিবেচনায় আনতে হবে। ইনস্টিটিউটে অনার্স ও মাস্টার্স চালু থাকায় তাদের সামর্থ্যের মূল্যায়ন করা। এ ধরনের প্রোগ্রামে লোকবল নিয়োগের প্রয়োজন হলে (পদসৃষ্টি) ইউজিসির অনুমোদন আবশ্যক। ভর্তি প্রক্রিয়া, পাঠদান, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও মূল্যায়ন এবং সনদ ইস্যু ইত্যাদি ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এসব কোর্সের কারণে নিয়মিত কোর্স, গবেষণা কার্যক্রম ও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক র্যাংকিং প্রভাবিত হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়ন। আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরূপণ। সন্ধ্যাকালীন প্রোগ্রামের শিক্ষকদের সম্মানীর হার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত প্রোগ্রামের হারের সঙ্গে যুক্তিসংগত পর্যায়ে আনা।
Discussion about this post