তথ্য অধিকার হচ্ছে ঐ ধরনের অধিকার যার মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্র দ্বারা গৃহীত বিভিন্ন কার্যাবলীর তথ্য-উপাত্ত নিজের বা অন্যকে জানানোর প্রয়োজনে পাওয়ার অধিকার রাখে। রাষ্ট্র বা সরকারের কাছ থেকে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার আজ বিশ্বব্যাপী একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘ দ্বারা ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে সরকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা গৃহীত কার্যাবলী সংক্রান্ত সকল তথ্য জানার অধিকার, পাওয়ার অধিকার এবং অন্যকে জানানোর অধিকারসমূহ অন্তর্ভুক্ত।’
তারই আলোকে জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় তথ্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। তথ্য প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার নিকট লিখিত বা যে কোন মাধ্যমে অনুরোধ জানাতে হবে। একাধিক তথ্য পেতে চাইলে ২০ কার্যদিবস সময় পাবেন তথ্যদাতা। যদি তথ্যটি ব্যক্তির জীবন-মৃতু, গ্রেপ্তার এবং কারাগার থেকে মুক্তি সম্পর্কিত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করতে হবে। সাধারণ জনগণতো বটেই এই আইন তৈরির ফলে বেশী উপকৃত হয়েছেন সাংবাদিক ও গবেষকরা। কারন রাষ্ট্রীয় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংবাদ তৈরি বা গবেষণার প্রয়োজনে তারা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, আর তথ্য চাওয়া বা পাওয়াটি তার অধিকার। আইন সেই অধিকারটি নিশ্চিত করেছেন।
তাছাড়া এই আইন তৈরির ফলে তথ্য প্রদানে বাধ্যবাধকতা থাকার দরুন সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে।
তথ্যপ্রাপ্তির প্রাথমিক ধাপ
তথ্য পাওয়ার জন্যে আইনের নির্দেশিত নির্ধারিত ফরম্যাটে লিখিতভাবে আবেদন জমা দিতে হয়। প্রয়োজনীয় তথ্যের সঠিক ও সুস্পষ্ট বর্ণনা দিতে হয় এবং কি পদ্ধতিতে তথ্য পেতে চান (পরিদর্শন/ অনুলিপি/ নোট নেওয়া বা অন্য কোন পদ্ধতি) তা আবেদনে উল্লেখ করতে হয়। সেই সাথে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য কাজের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
তথ্যলাভে ব্যর্থ হলে আপিল
আইনের ২৪ ধারার বিধান মোতাবেক দু’টি কারণে আপনি তথ্যপ্রাপ্তির জন্যে আপিল দায়ের করতে পারবেন- কোন ব্যক্তি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট থেকে যদি চাহিত তথ্য না পান তাহলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে( কার্যদিবস নয়) আপিল করতিপক্ষের নিকট আপিল করতে পারবেন। এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যদি কোন সিদ্ধান্ত দেয় বা অসম্পূর্ণ তথ্য দেয় বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয় এবং আপনি যদি উক্ত সিদ্ধান্ত বা তথ্য দ্বারা সংক্ষুব্ধ হন, তাহলে অনুরূপ সিদ্ধান্ত প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতিপক্ষের বরাবর আপিল করা যায়। আপিল করতিপক্ষ আপিল আবেদন প্রাপ্তির পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে আপিল আবেদনকারীকে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহের জন্যে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিবেন অথবা গ্রহণযোগ্য না হলে আপিল আবেদনটি খারিজ করে দিবেন।
আপিলে ব্যর্থ হলে আছে কমিশন
আপিলের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে বা নির্ধারিত সময়সীমায় তথ্য না পেলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। অভিযোগ প্রাপ্তির পর প্রধান তথ্য কমিশনার নিজে অভিযোগটি অনুসন্ধান করবেন বা অন্য কোন তথ্য কমিশনারকে দায়িত্ব দিবেন। প্রাপ্ত অভিযোগ তথ্য কমিশন সাধারণভাবে ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। তবে অভিযোগ নিষ্পত্তির সময়সীমা কোনভাবেই ৭৫ দিনের অধিক হবে না।
কোন কোন ধরনের তথ্য দিতে সরকার বা কর্তৃপক্ষ বাধ্য নয়
তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, নিন্মবর্ণিত তথ্য সরকার বা করতিপক্ষ প্রকাশ করতে বাধ্য নয়ঃ দেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে এ ধরনের তথ্য; পররাষ্ট্রনীতির কোন বিষয়, যা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক ক্ষুন্ন হতে পারে; বিদেশী সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গোপনীয় কোন তথ্য; কোন তৃতীয় পক্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এ ধরনের বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক অন্তর্নিহিত গোপনীয় বিষয়, কপিরাইট সম্পর্কিত তথ্য; আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট ও আবগারি আইন, বাজেট বা করহার পরিবর্তন সংক্রান্ত আগাম তথ্য, মুদ্রার বিনিময় ও সুদের হার পরিবর্তনজনিত আগাম তথ্য; ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও তদারকি সংক্রান্ত আগাম তথ্য; তথ্য প্রকাশের ফলে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে; জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত বা বিচারাধীন মামলার বিচারকাজ ব্যাহত পারে এরূপ তথ্য; ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুন্ন ও শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হওয়ার আশংকা থাকলে; আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তার জন্য কোন ব্যক্তির দেওয়া গোপন তথ্য; আদালত বা ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বা যা প্রকাশ আদালত অবমাননার শামিল; তদন্তাধিন বিষয় যার প্রকাশ তদন্ত কাজে বাধা হতে পারে; ক্রয় কার্যক্রম সম্পূর্ণ হওয়ার আগে বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে সংক্রান্ত কোন তথ্য; জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিকারহানির কারন হতে পারে এরূপ তথ্য; আইনের মাধ্যমে সংরক্ষিত গোপন তথ্য; পরিক্ষার প্রশ্ন বা পরিক্ষার প্রদত্ত নম্বরের আগাম তথ্য; মন্ত্রীপরিষদ, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপিত সার-সংক্ষেপসহ আনুষঙ্গিক দলিল এবং বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে এ ধরনের পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সিদ্ধান্তের কারন এবং যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ করা যাবে।
কোন কোন প্রতিষ্ঠান তথ্য দিতে বাধ্য নয়
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা(এনএসআই), ডিজিএফআই, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ইউনিটসমূহ, সিআইডি(পুলিশ), এসএসএফ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা সেল, এসবি(পুলিশ), র্যাব এর গোয়েন্দা সেল।
উপরের ৮ টি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য অধিকার আইনে আপনি কোন তথ্য চাইতে পারবেন না। তবে দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য শর্ত সাপেক্ষে পাওয়া যাবে।
ড. বদরুল হাসান কচি
Discussion about this post