ডেস্ক রিপোর্ট
‘মোটরসাইকেলে বসা সামনের লোকটি আপার হাতের বালা টানাটানি করে। এ সময় আপা বলেন- তুমি আমার সঙ্গে এগুলো করো না, আমি তোমাকে চিনি। আপা লোকটিকে চিনি বলার সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেলের আরোহীরা তাকে গুলি করে।’
রোববার (২০ মার্চ) সগিরা মোর্শেদকে বহনকারী রিকশাচালক সালাম মোল্লা ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে জবানবন্দিতে একথা বলেন।
সালাম মোল্লা জবানবন্দিতে বলেন, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে শাহজাহানপুরের শহীদবাগ থেকে রিকশা নিয়ে রাজারবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। রাজারবাগ গলির মুখ থেকে সগিরা মোর্শেদ আমাকে ডাক দিয়ে বলেন, সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুননিসা স্কুলের সামনে যাব কি না? আমি যাব বলি এবং চার টাকা ভাড়া ঠিক করি। তাকে মালিবাগের কাছে পেট্রল পাম্পের কাছে গিয়ে আমি বলি, আপা শান্তিনগর দিয়ে যাবো? তখন আপা বলেন, ‘না, তুমি সিদ্ধেশ্বরীর ভেতর দিয়ে যাও। এদিক দিয়ে কাছে হবে।’
সালাম মোল্লা আরও বলেন, সিদ্ধেশ্বরীর ভেতর ঢুকে কালীমন্দিরের সামনে এলে একটি মোটরসাইকেল বের হয়ে আসে। সেখানে দুজন লোক ছিল। ঘটনাস্থল ভিকারুননিসার দুই বাড়ির পূর্বে আমার রিকশা এলে মোটরসাইকেলটি আমার রিকশার সামনের চাকার সামনে এসে ব্রেক করে এবং ব্যারিকেড দেয়। আপার হাতে একটি ব্যাগ ছিল। মোটরসাইকেলের পেছনে বসা লোকটি ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে নেয়। সেটা মোটরসাইকেলে বসা সামনের লোকটির কাছে দেয়। এরপর মোটরসাইকেলে বসা সামনের লোকটি আপার হাতের বালা টানাটানি করে।
ঘটনার বর্ণনায় রিকশাচালক বলেন, গুলি আপার বুকের বাম পাশে লাগে। আপা রিকশা থেকে পড়ে যেতে লাগলে আমি হাত দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখি। যাওয়ার সময় তারা আরও একটি গুলি করে।
তিনি বলেন, এরপর আমি একটি আধলা ইট নিয়ে হাইজ্যাকার হাইজ্যাকার বলে মোটরসাইকেল আরোহীদের পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি। ভিকারুননিসা স্কুলের কাছে মহিলা সমিতি পর্যন্ত দৌঁড়ে যাই। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। তারপর আমি আবার রিকশার কাছে যাই। সেখানে অনেক লোকজন দেখি। তারা আমাকে বলে, আপাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এরপর আমি রমনা থানায় যাই এবং ঘটনা পুলিশকে জানাই। তারপর থানার পুলিশসহ আমি আবার ঘটনাস্থলে আসি।
এ নিয়ে মামলাটিতে এ দফায় ৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এদিন তার সাক্ষ্য শেষ না হওয়ায় আগামী ৩০ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন আদালত।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সগিরা মোর্শেদ সালাম ১৯৮৯ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে মেয়েকে আনতে যান। বিকেল ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী রোডে মোটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীরা তার হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সগিরা নিজেকে বাঁচাতে দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান।
ওই ঘটনায় সেদিনই রমনা থানায় মামলা করেন তার স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী। পরে মিন্টু ওরফে মন্টু ওরফে মরণের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আসামি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দিক। সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় সাতজনের। সাক্ষীতে মারুফ রেজা নামে এক ব্যক্তির নাম আসায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই বছরের ২৩ মে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন মামলা (১০৪২/১৯৯১) করেন মারুফ রেজা। যিনি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় ছিলেন। ১৯৯১ সালের ২ জুলাই ওই তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। ১৯৯২ সালের ২৭ আগস্ট ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে মর্মে আরেকটি আদেশ দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ২৬ জুন এ মামলার ওপর ২৮ বছর ধরে থাকা স্থগিতাদেশ তুলে নেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে পিবিআইকে মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দেন।
একই বছরের ২০ নভেম্বর পিবিআইকে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তদন্তের জন্য আরও ৬০ দিনের সময় দেন। এরপর পিবিআই বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করে। চারজনই হত্যার দায় স্বীকার করে বিচারিক আদালতে জবানবন্দি দেন।
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ এ মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
এর আগে ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সগিরার ভাসুরসহ চারজনকে আসামি করে এক হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম।
মামলার আসামিরা হলেন- সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন, হাসান আলীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান এবং ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা।
Discussion about this post