ধর্ষণের প্রমাণ বেশি প্রয়োজন নাকি ধর্ষকের শাস্তি?
খবরের কাগজ থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের প্রতিটি মাধ্যমের সবচেয়ে পরিচিত শিরোনামের নাম এখন ধর্ষণ। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষিতা এবং ধর্ষক এই শিরোনামের প্রধান চরিত্রের নাম। দুঃখজনক হলেও বাস্তব, প্রতিটি ধর্ষণে ধর্ষিতার পরিচয় পাওয়া গেলেও ধর্ষকের পরিচয় পাওয়া যায় হাতে গণা কিছু সংখ্যক। “কে ধর্ষণ হয়েছে” আমরা সেই আলোচনায় যতটনা সময় দেই তার হয়ত অনেকাংশই কম আলোচনা করি “কে ধর্ষণ করেছে” তা নিয়ে। ধর্ষণ এবং ধর্ষক এই দুইটা শব্দ যেন বাংলাদেশের নারীদের কাছে এখন এক মূর্তমান আতঙ্ক, কারণ পরবর্তী ধর্ষিতার ছবি যেন অবচেতন মন নিজের ছবিকেই বারবার দেখায়।
দেশে ধর্ষণের সংখ্যা লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। যারফলে, সাধারণ জনগনের মনেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে,”ধর্ষণের বিচার নেই কেন?” সাধারণ মানুষের এই প্রশ্ন কি অযৌক্তিক না যৌক্তিক তা হয়ত গুরুতর কোন প্রশ্ন না কিংবা এই প্রশ্নের উদ্দ্যেশ্যে কিন্তু বিচারবিভাগ-কেও প্রশ্নবিদ্ধ করেনা। এই প্রশ্নটির উদয় হয়েছে ঠিক তখনি, যখন মানুষ নারীর নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত অভাব অনুভব করেছে। আর এই প্রশ্নটি যে শুধু নারীদের একার তা কিন্তু নয়, বরং নারী-পুরুষ সকলেরই। কারণ, একজন নারী কোন না কোম পুরুষের মা-বোন কিংবা স্ত্রী অথবা কোন আত্বীয়। তাই ধর্ষক পুরুষ হলেও এই কলঙ্কিত পুরুষের বিচার চাওয়া হয় শুধুমাত্র দেশের নারীদের ধর্ষণ কমিয়ে আনার জন্যই।
কোন তরূণী,শিশু,নারী কিংবা অন্য যে কেউ ধর্ষণের শিকার হয় তখন সেই ভুক্তভোগী এবং তার নিকটজনেরা সর্ব প্রথম চেষ্টা করে তাকে বাচানোর জন্য, তারপর যায় ধর্ষকের বিচার চাইতে। কেউ কিন্তু তখন ধর্ষিতার সম্ভ্রম ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেনা, কারণ তা অসম্ভব। কিন্তু সবাই যে চেষ্টাটা করে তা মূলত ধর্ষক-কে উপযুক্ত শাস্তি দিতে, যাতে করে পরবর্তী কোন নারীর ধর্ষণের শিকার না হয়। কিন্তু তবুও কেন এই ধর্ষকদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছেনা হয়ত তার শতভাগ সঠিক কারণ বলতে পারবে না, তবে প্রায় সবার আঙ্গুলই যেন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শুধু সাধারণ মানুষেরই নয় বরং, দেশের বড় পর্যায়ের ব্যাক্তিত্বগণ ও এই বিষয়ের সাথে সমর্থণ জানায়। এমনকি গুগুলে যদি “বাংলাদেশে ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ” লিখে সার্চ দেয়া হয় তখনও পর্যন্ত একটাই কারণ খুজে পাওয়া যায়।
কিন্তু বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে যদি একদম সুক্ষভাবে বিষয়টিকে নিয়ে খতিয়ে দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের ধর্ষণ সম্পর্কিত যে আইন রয়েছে এবং ধর্ষণের যে সাজা রয়েছে তা থেকে কোন ধর্ষকের রেহাই পাওয়া তো যাবেইনা বরং শাস্তির ভয়ে কেউ হয়ত এরূপ কর্মের কথা ভাবতেও চাইবেনা। কিন্তু এত কিছুর পরেও কেন তার উল্টোটাই হচ্ছে এই প্রশ্ন যেন এখন আতঙ্কের প্রধাণ কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
এবার আশা যাক ধর্ষণ পরবর্তীকালীন বিষয়গুলো নিয়েঃ
কেউ ধর্ষণ হলে, তাকে চিকিৎসা দেয়ার পরে সাধারণত ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, পুলিশ ইনভেস্টিগেশন কিংবা ইনকোয়্যারির মাধ্যমে ঘটনার নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে অভিযুক্তকে কোর্টে উঠানো হয় এবং বিবাদী যদি ধর্ষক হিসেবে প্রমাণীত হয় তখনই উক্ত ব্যাক্তি আসামী কিংবা প্রকৃত ধর্ষক হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তখন থেকেই শুরু হবে শাস্তি প্রক্রিয়া।
উপরোক্ত বিষয়টি সার্বিকভাবে খুব সহজ একটি প্রক্রিয়া মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু পুরাই বিপরীত। কারণ, বিবাদীকে প্রকৃত ধর্ষক হিসেবে প্রমাণ করাটাই বাদীর পক্ষে একটা চ্যালেঞ্জিং ইস্যু হয়ে দাড়ায়।
যখন কোন ধর্ষিতা বাদী হয়ে মামলা করেন তখন তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এমসি কিংবা ফরেন্সিক টেস্ট করা হয় এবং বিভিন্ন আলামতের মাধ্যমে ধর্ষণ নিশ্চিত করা হয়। যদিও একটি ধর্ষণ নিশ্চিত করতে ভিক্টিমকে যেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাতে করে ভিক্টিম এর মানসিক অবস্থা বুঝার ক্ষমতা যেন অন্য ভিক্টিম এবং স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ বুঝার ক্ষমতা রাখেনা। কিন্তু শতকিছুর পরেও বিচারপ্রার্থীর কিংবা ভিক্টিমের ধর্ষণের নিশ্চয়তার পাওয়ার সংখ্যাই দাঁড়ায় বেশি।
অপরদিকে, বিবাদী কিংবা আসল ধর্ষক-কে চিহ্নিত করাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার হয় না। কারণ, একটি
ধর্ষণের পরে ধর্ষিতার শরীরে ধর্ষণ প্রমানের একাধিক মাধ্যম থাকলেও ধর্ষণকারী ব্যাক্তির কিন্তু এমন কোন শারিরিক অবস্থার পরিবর্তন হয়না যার দ্বারা সহজেই ধর্ষক প্রমাণ করা যায়। ধর্ষক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত ডিএনএ টেস্ট করা হয় যার নমুনা যেমনঃ বীর্জ, দেহকোষ ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয় ধর্ষিতার দেহ থেকে। অথচ, পুরুষের বীর্য বেঁচে থাকে সাধারণত ১২ থেকে ৭২ ঘন্টা।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের পর একটি মেয়ের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে যেই সময় লাগে এবং তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা যতটা এলোমেলো হয়ে যায় সেই সময়টুকু ব্যবহার করেই মূলত একজন ধর্ষক আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেঁচে যায়। কারণ, বাংলাদেশের সামাজিক চিত্রের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ভিক্টিম ধর্ষণের পর মামলা করতে এবং মেডিকেল টেস্ট অবধি যে সময় ব্যায় হয় তাতে করে ভিক্টিমের বডি থেকে ধর্ষকের রেখে যাওয়া প্রায় সব নমুনাই নষ্ট হয়ে যায়। আর এই নমুনা একবার নষ্ট হয়ে গেলে তখন ধর্ষণের সত্যতা প্রমাণ পাওয়া গেলেও কিন্তু বেশিরভাগ ধর্ষণকারীকেই কে প্রমাণ করা সম্ভব হয়না।
ধর্ষক প্রমাণের আরেকটি উপায় থাকে সাক্ষী। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি আমাদের দেশের বেশিরভাগ ধর্ষণগুলি এমন জায়গায় হয়ে থাকে যা সাধারণত নির্জন এবং জনমানবহীন হয়ে থাকে। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে তেমন কোন মানুষ চাক্ষুষ সাক্ষীও হয় না। আর যেসব ক্ষেত্রে হাতেগণা কিছু সাক্ষী পাওয়া যায় তাও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর কৌশলী জেরার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে।
ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাধারণত এই পয়েন্ট এর দূর্বলতাকেই আইনের ফাঁক-ফোকড় হিসেবে ধরা নেই।থাকে। কারণ, এখাণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়ায় আসল ধর্ষক কে খুজে বের করা। আর প্রকৃত ধর্ষক সনাক্ত না হলে তাকে বিচারের আওতায়ও আনার উপায় নেই।
কোন ধর্ষণ কে ব্যখ্যা করতে গেলে যে বিষয়গুলো প্রধান তা হলঃ ধর্ষণ,ধর্ষক এবং ধর্ষিতা। কিন্তু কোন ধর্ষণের পর আমরা সবার প্রথম জেনে থাকি ধর্ষিতার পরিচয়। শিরোনাম কিংবা খবরের হেডলাইনেও সর্বপ্রথম প্রকাশ করা হয় ধর্ষণ শব্দটি এবং ধর্ষিতার পরিচয়, পরবর্তীতে আসে ধর্ষকের কথা। কারন খুব সহজ, কেননা ভুক্তভোগী ই আওয়াজ তুলতে চায় কিন্তু অপরাধী চায় পালিয়ে বেড়াতে। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এর বিপরীত নয়। তাই আমরা “বিচার চাই, বইচার চাই” বলে আওয়াজ ঠিকি তুলে থাকি কিন্তু বিচার টা কার চাই? অবশ্যই ধর্ষকের বিচাই চাই, কিন্তু ধর্ষককে আমরা চিনব কিভাবে সেই উত্তর কি জানি? তাই ধর্ষক প্রমাণের বিষয়টিও দেখতে হয় আদালতকে, আর ধর্ষক নির্ধারণ ও বিচারের মাঝে পড়ে যায় এক বিশাল দূরত্ব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষকের সঠিক বিচার না হওয়ার পেছনে আইনের যে দুর্বলতাটি রয়েছে তার কারণ ধর্ষণ সাধারণত একটি ফৌজদারী অপরাধ এবং, ফৌজদারি আইনের দর্শন হলো: এই আইনের অধীনে কোনো মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়৷ কোনো সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না। আসামিরা সব সময়ই ‘বেনিফিট অফ ডাউট’-এর সুযোগ পেয়ে থাকেন। আর বাংলাদেশে ধর্ষনের ক্ষেত্রে শতভাগ শর্ততা কতটা কঠিন তার দুঃখজনক বর্ণনা আমাদের সকলেরই জানা।
ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন এবং বিচার সংক্রান্ত জটিলতাঃ
বাংলাদেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা বর্ণনা করা হয়েছে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী২০০৩) এর ধারা ৯” এবং “দন্ডবিধির ধারা ৩৭৫”-এ ।
ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০” এর ধারা ৯(ক), ৯(খ), ৯(গ) ও ৯(ঘ) তে।
“নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০”-এর অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচারের লক্ষ্যে জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এই ট্রাইবুনালের সংখ্যা ১০১টি এবং ১০১টি ট্রাইবুনালের অধীনে চলমান মামলা প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার।
একটি ধর্ষণ মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে বাদীর ক্ষেত্রে এক পর্যায়ে মামলা চালানোইয় অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় এবং বাদীপক্ষ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, বিবাদীর পথ তখন আরও মসৃণ হয়ে যায় এবং সময়ের যথাযথ প্রয়োগ করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।
দীর্ঘমেয়াদী মামলা পরিচালনা এবং বাদীর সঠিক বিচার না পাওয়ায় ট্রাইব্যুনালের স্বল্পতা কতটা অন্তরায় তা হয়ত বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২০ ধারা মোতাবেক বিশেষভাবে দ্রুত বিচার করার লক্ষ্যে শুধু ট্রাইব্যুনালে এই মামলার বিচার কার্যক্রম চলবে।
২০(২) উপ-ধারা মোতাবেক ট্রাইব্যুনাল প্রতি কর্মদিবসে একটানা বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশনা আছে।
২০(৩) উপ-ধারা মোতাবেক ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পাদনের নির্দেশনা থাকলেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছেনা। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ট্রাইবুনালে যে পরিমাণে মামলা হয় সেই তুলনায় বিচারকের স্বল্পতা থাকায় মামলা জট হওয়ার একটি অন্যতম কারণ।
এই স্বল্পতাসত্বেও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আলোচিত কিছু মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করেছে উক্ত ট্রাইবুনালটি,যা সাধারণ মানুষের মনে নিঃসন্দেহে অনেক্ষানি আশার দুয়ার।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক ধর্ষণ এবং নারীদের নিরাপত্তা এখন সময়ের চাহিদা । আমাদের দেশের আইন প্রতিবেশীদেশ ভারতের আইনের চেয়ে অনেক শক্তিশালি ও কার্যকর। তবুও বেড়েই চলছে ধর্ষণের সংখ্যা। বছর বছর ধর্ষণ বৃদ্ধির হার শিউরে উঠার মত।
দেশের যুবসমাজ,নারী,শিশু সকলকেই রাস্তায় নেমে ধর্ষকের বিচার চাইতে হচ্ছে আজ, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইতে হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিচারব্যবস্থা।
একটি চরম বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে একটি উন্নত ও কার্যকরী আইন থাকার পরেও জনমনে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে শুধুমাত্র প্রয়োগের অভাবে।
বর্তমানে যে হারে ধর্ষণ বাড়ছে তার প্রতিরোধে সর্রবপ্রথম প্রয়োজন “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০” এর যথার্থ প্রয়োগের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাইবুন্যাল এবং পাশাপাশি সরকারিভাবে স্পেশাল চৌকশ টীমের সমন্বয়, যার মাধ্যমে দ্রুত ধর্ষক নির্ধারন সহজ হবে এবং প্রয়োজনে কোন মামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে যাতে করে কোন ধর্ষক অন্ততপক্ষে সাক্ষীর অভাবে পার পেয়ে না যায়।
মুবিন হাসান খান অয়ন: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, জেড. এইচ. সিকদার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি।
Discussion about this post