ডেস্ক রিপোর্ট
পক্ষপাতমূলক মেডিকেল রিপোর্ট দেওয়ার কারণেই ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত জানান, যার কারণে ধর্ষকরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এক নারীর মেডিকেল রিপোর্টের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে রোববার হাজির হওয়া দুই চিকিৎসকের উদ্দেশে এসব মন্তব্য করেন আদালত।
জানা গেছে, ঢাকার একটি গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন ভিকটিম। চাকরির সুবাদে পরিচয় হয় লাখাই উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের দেলোয়ার হোসেন দিলুর মেয়ে কোহিনুর আক্তারের সঙ্গে। সেখানে গত ৬ মার্চ তার বান্ধবীর বিয়ে ও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের (গ্যাং রেপ) শিকার হন ওই নারী। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে গত ১২ মার্চ। শুধু তাই নয়, সিলিংফ্যানে ঝুলিয়ে তার আত্মহত্যার নাটক সাজানোরও চেষ্টা করে ধর্ষণকারীরা।
পরে ১৫ মার্চ ভিকটিমকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ১৬ মার্চ মেডিকেল রিপোর্ট দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পরে ১৯ মার্চ মামলা করা হয়। ওই মামলার এক আসামির জামিন শুনানি ছিল। ওই আসামিকে জামিন দেননি আদালত।
তবে, ওই নারীর শরীরে জোরপূর্বক ধর্ষণের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি মর্মে মেডিক্যাল রিপোর্ট ও মৌখিক ব্যাখ্যা দেন হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের দুই চিকিৎসক। তাই এর আগে দুই চিকিৎসককে তলব করা হয়েছিল।
একজন নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও কেন তার শরীরে কোনো চিহ্ন পেলেন না চিকিৎসকরা তার ব্যাখ্যা দিতে হাজির হন হাইকোর্টে। পরে ওই দুই চিকিৎসক রিপোর্টের পক্ষে মৌখিক ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু তাদের ওই ব্যাখ্যায় হাইকোর্ট সন্তুষ্ট হননি।
আদালত ওই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে আদেশ দিতে চান। এ সময় দুই চিকিৎসক আদালতে ক্ষমা চান।এরপরই হাইকোর্ট আগামী রোববার (২৮ নভেম্বর) ওই দুই চিকিৎসককে (আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোমিন চৌধুরী ও সার্জন ডা. নাদিরা বেগম) তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত ব্যাখ্যা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
রোববার (২১ নভেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি ফরিদ আহমেদ ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এদিন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ। তাকে সহায়তা করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. শামীম খান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ শাফায়াত জামিল। আর আসামি রাবিয়া খাতুনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট হারনুর রশিদ।
শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, আমরা ক্ষমা করতে বসিনি, বিচার করতে বসেছি। এ ধরনের পক্ষপাতমূলক রিপোর্ট দেওয়ার কারণেই ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে ধর্ষকরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের উচিত ধর্ষণের ঘটনায় গুরুত্বসহকারে ভিকটিমের শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা। যাতে ধর্ষকরা কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়।
এফআইআর সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মার্চ হবিগঞ্জের লাখাইয়ে বান্ধবী কোহিনুরের বিয়ে ঠিক করার সময় তার বাড়িতে বেড়াতে আসেন ওই নারী। এ সময় কোহিনুরের আত্মীয় ও একই গ্রামের মনা মিয়ার ছেলে শিপন মিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেখানে বখাটেদের উত্ত্যক্তের শিকার হন এই নারী। পরে প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ১২ মার্চ তিনি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।
সেখানে শিপন মিয়া ও তার তিন সহযোগী মিলে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার জন্য ওই ঘরের সিলিংয়ে তাকে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে যায় ধর্ষণকারীরা।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তাৎক্ষণিক ওই বাড়ির লোকজন দরজা খুলে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু তারা ধর্ষণের বিষয়টি লুকিয়ে রেখে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ঘটনার তিন দিন পর গত ১৫ মার্চ ওই নারীকে তার বড় বোনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এদিকে বোনকে পেয়ে সাহস পান এবং ঘটনার সবকিছু খুলে বলেন তিনি।
পরে হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। চিকিৎসা শেষে ১৯ মার্চ ভিকটিম ও তার বোন লাখাই থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় মো. শিপন মিয়া (২২), মো. পারভেজ (২০), মো. হুমায়ুন মিয়া (২০), মো. শাহজাহান (২২), আফিয়া আক্তার (৩০), দেলোয়ার হোসেন দিলু (৪৫) ও রাবিয়া খাতুনকে (৩৫) আসামি করা হয়। এর মধ্যে প্রথম চার আসামি ওই নারীকে ধর্ষণ করে। অপর আসামিরা এ কাজে সহায়তা করে।
অভিযোগ পেয়ে ওই রাতেই লাখাই থানা পুলিশ নোয়াগাঁও গ্রামে অভিযান চালিয়ে আশরাফ উদ্দিনের স্ত্রী আফিয়া বেগম, মকবুল হোসেনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন দিলু ও তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে গ্রেফতার করে।
এরপর আফিয়া বেগম ও রাবেয়া খাতুনকে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা বেগমের আদালতে পাঠায় পুলিশ। সেখানে তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ঘটনার বিষয়টি স্বীকার করে।
এ মামলায় হাইকোর্টে জামিন চান রাবিয়া খাতুন। ওই জামিনের আবেদন শুনানিকালে ভিকটিমের মেডিক্যাল রিপোর্টে চিকিৎসকদের দেওয়া মতামতের বিষয়টি নজরে আসে। এরপরই হাইকোর্ট দুই চিকিৎসককে তলব করেন। রোববার তারা সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
কিন্তু আদালত আবারও তাদের আগামী ২৮ অক্টোবর সশরীরে উপস্থিত হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন।লাখাই থানার ওসি তদন্ত মহিউদ্দিন বলেন, ভিকটিমের মৃত্যু না হওয়ায় প্রকৃত রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে।
Discussion about this post