অতনু সাগর:
ধর্ষণ: সাধারন ভাবে ধর্ষন বলতে বুঝায়, নারী বা পুরুষ যে কোন একজনের অমতে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকে। তবে আমরা যে সমাজে বাস করি তার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষনের শিকার শুধুমাত্র নারীরা। কিন্তু আমাদের এই ধারণা পুরোপুরিভাবে ‘ধর্ষণ’-কে সংজ্ঞায়িত করে না। দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’-কে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা হলোঃ
যদি কোন পুরুষ নিম্নবর্ণিত পাঁচ প্রকারের যে কোন অবস্থায় কোন নারীর সাথে যৌন সহবাস করে তবে সে ব্যক্তি নারী ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে-
১. কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা
২. কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া অথবা
৩. কোনো নারীকে মৃত্যু বা শারীরিক আঘাতের ভয় দেখিয়ে সম্মতি দিতে বাধ্য করলে অথবা
৪. নাবালিকা অর্থাৎ ১৬ বছরের কম বয়স্ক শিশু সম্মতি দিলে কিংবা না দিলে (সে যদি নিজ স্ত্রীও হয়) অথবা
৫. কোনো নারীকে বিয়ে না করেই ব্যক্তিটি তার আইনসঙ্গত স্বামী এই বিশ্বাস দিয়ে যদি কোনো পুরুষ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে আইনের ভাষায় ধর্ষণ বলা হবে ।
এখানে উল্লেখ্য যে, অনুপ্রবেশই নারী ধর্ষণের অপরাধ রূপে ‘গণ্য হবার যোগ্য যৌনসহবাস’ অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ দন্ড বিধি ধারা -৩৭৫ , জাতীয় ই-তথ্যকোষ
ধর্ষনের কারনঃ
খুব অল্প কথায় ধর্ষনের কারন বিশ্লেষন করা খুবই দুরহ একটি ব্যাপার।তারপরও যদি বলতে যাই তাহলে বলতে হবে, ধর্ষণ একটি মানসিক বিকৃতি। একজন মানুষের মনুষ্যত্ব যখন শূন্যের কোঠায় চলে আসে তখনই সে ধর্ষন নামক একটি পৈচাশিক অপরাধ করে।
তবে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে বিভিন্নভাবে নানা সময়ে ধর্ষনের জন্য ঘুরে ফিরে কেবলমাত্র মেয়েদেরকেই দায়ী করা হয়। এই ক্ষেত্রে মূল যে কারনটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বলে প্রতিয়মান তা হচ্ছে মেয়েদের শালীন পোষাক পড়ার অন্তরায়। অনেকেই এই কারনটি দৃঢ় ভাবে সমর্থন করেন। যারা এই কারনটি মানেন, তারা মনে করেন, মেয়েরা হচ্ছে আগুনের মত এবং ছেলেদের যৌনসংযম অনেকটা মোমের মত। মোম যেমন আগুনের সংস্পর্শে আসলেই গলে যায় তেমনি অশালীন পোষাক পরা একজন নারীর সামনে একজন পুরুষ আসলে তারও ভদ্রবেশী মুখোশ গলে গিয়ে কামনাময় চেহারা বের হয়ে আসে। ফলে এই কামনাবৃত্তি মেটাতে গিয়েই ধর্ষনের মত ঘটনা ঘটে। তারা কিন্তু আবার নীতিগত ভাবে ধর্ষন সমর্থন করেন না।
আবার আর একপক্ষ আছেন যারা মনে করে থাকেন, নারী ধর্ষনের জন্য কেবল মাত্র পুরুষদের অতি কামনাময় চরিত্র এবং অতি সংবেদশীল একটি শারীরিক অংগই দায়ী। একজন নারীর অধিকার আছে তার ইচ্ছামাফিক পোষাক পরার। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পুরুষরা একজন যৌনাবেদনময়ী নারীর দিকে চোখ নামিয়ে বা কামহীন দৃষ্টিতে তাকানো বন্ধ করতে পারে না দেখে তাদের দু পায়ের মাঝখানে একপায়া বিশিষ্ট তাবু সংক্রান্ত একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং এই থেকে মুক্তি লক্ষ্যে পুরুষরা ধর্ষন করে থাকেন।
প্রিয় পাঠক ( পড়ুন সচেতন পাঠক), ধর্ষনের এই সামগ্রিক বিশ্লেষন গত বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ব্লগে ফেসবুকে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচিত হতে দেখেছি। আর প্রতিবারই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছি কিছু গুনী মানুষের এহেন ব্লগীয় বিশ্লেষনে। সত্যি বলতে যে সমাজের এক অংশে এই ধরনের ধারনা প্রচলিত থাকে সেখানে নতুন করে ধর্ষনের কারন খোঁজাটা সত্যি খুবই দূরহ এবং কঠিন একটি ব্যাপার। কারন আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত ধারনা ভেঙে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ধর্ষনের মূল কারন হচ্ছে কোন ব্যক্তির মানসিক বিকৃতি, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক সচেতনতা, নারীপুরুষের সম অধিকারের অপব্যবহার এবং সর্বপরি আইনের শাসনের প্রয়োগ না হওয়া।
দেখুন একজন মানুষ হিসেবে একজন নারী বা পুরুষ অবশ্যই তার ইচ্ছেমাফিক পোষাক পড়তে পারে। এটা তার অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার। তবে তিনি কিভাবে এই অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রয়োগ কিভাবে করছেন সেটা বিবেচনার বিষয়। যেমন ধরুন, আপনি প্রকাশ্যে কোন মূল্যবান জিনিস প্রদর্শন করে নিয়ে যেতেই পারেন। এটা আপনার নাগরিক অধিকার। সেই সাথে আপনার সেই মূল্যবান জিনিসকে সঠিক নিরাপত্তার মাধ্যমে আপনার গন্ত্যবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনার সচেতনতা এবং দায়িত্ব। এখন কোন কারনে নিরাপত্তাজনিত কোন সমস্যায় আপনি যদি আপনার মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে ফেলেন, তাহলে রাষ্ট্র যেমন দায়ী হবে তেমনি সচেতনতার অভাবে আপনিও কম দায়ী হবেন না। তখন যদি আপনি এক তরফা ভাবে রাষ্ট্রকে দায়ী করেন তাহলে সেটা খুব বেশি গ্রহন যোগ্য হবে না।
আমি মনে করি পোষাক, আচরন ইত্যাদি ক্ষেত্রে শালীনতার যে বিষয়টি বার বার বলা হচ্ছে তা মূলত শুধু কোন এক পক্ষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং শালীনতা একটি সার্বজনীন ব্যাপার। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি সমান ভাবে প্রযোজ্য। যারা শুধু মাত্র নারীর পোষাককে ধর্ষনের জন্য দায়ী করেন তারা সংকীর্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। শুধুমাত্র অশালীন পোষাকের কারনে ধর্ষন – কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। যারা এমনটা ভাবেন তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ভাই আপনারা বিদেশে কখনও যদি যান (উচ্চ শিক্ষা ও বেড়ানো) তাহলে দয়া করে শুধু মাত্র আফগানিস্থান, সৌদি আরব কিংবা মরুভূমি অঞ্চলে যাবেন। কারন অন্য কোন সভ্য দেশে গেলে আপনি এই অশালীন পোষাক দেখে দেখে নিজেও একজন ধর্ষক হয়ে যেতে পারেন। এমনিতে নিজের দেশে ধর্ষনের ব্যাপারে বড়ই বিব্রত অবস্থানে আছি, তার উপর যদি আবার বিদেশে (ভারতে তো অবশ্যই না, টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন ভারতীয় নায়িকার কামুক পোষাক দেখে সেখানে গেলে আপনারা ভারতে যে কি ভয়াবহ কান্ড ঘটাবেন তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে) গিয়ে কেউ ধরা খান তাহলে জাতির মান ইজ্জত সবই যাবে।
আমাদের দেশের মেয়েরা কি খুব অশালীন কাপড় পড়ে ? উত্তর না, আমাদের দেশের মেয়েরা খুব বেশি একটা অশালীন পোষাক পড়ে না।তথ্য প্রযুক্তির সাথে সাথে গত দশকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছি তাতে বাংলাদেশী মেয়েরা যদি সেলোয়ার কামিজ ছেড়ে শর্ট স্কার্ট এবং আটসাটো টপস পড়ে রাস্তায় ঘুরতো তাতে অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু অধিকাংশ মেয়েই তারা তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক রক্ষনশীলতার ব্যাপারটিকে মর্যাদা দিয়েছেন। তারা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন যতটা না জড়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন অন্তত পোষাকের দিক দিয়ে এখন ততটা এগিয়ে যেতে পারেনি। তাই তাদের পোষাক এখনও অনেক মাত্রায় শালীন। তবে একজন বিকৃত মনের মানুষ কি দেখে কামনা অনুভব করবে তা নির্ধারন করা আসলেই একটি কঠিন একটি ব্যাপার। আমি এমন অনেককেই চিনি যারা হয়ত মেয়েদের পায়ে নুপুর দেখলেই শিহরিত অনুভব করেন।
তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা কোন ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। গুটি কয়েক নারী নিজেদের অতি আধুনিক প্রমান করতে গিয়ে অশালীন পোষাক, অন্য নারীদের জন্য অপমানসূচক অপবাদ বয়ে আনছেন এবং তার কারনে সৃষ্ট কামনায় বলী হচ্ছে অন্য আর একজন নিরীহ নারী।
ধর্ষনের মূল কিছু কারন হচ্ছে ইভটিজিং, অপসংস্কৃতির প্রভাব, মোবাইল পর্ণোগ্রাফি এবং আইনের শাসন প্রয়োগের দূর্বলতা। ইভটিজিং যারা করে তারা যদি সঠিক সময়ে বাধা না পায়, বা সংশোধনের সুযোগ না পায় তাহলে তারা পরবর্তীতে ধর্ষক হিসেবে পরিনত হয়। আমাদের দেশে যদিও এখন অনেক সচেতনতা বেড়েছে কিন্তু তারপরও ইভটিসিং বন্ধ করতে না পরলে ধর্ষক বন্ধ হবে না।
একটি যৌনাবেদনময়ী মেয়েকে দেখে একজন ছেলের যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই। তারাও একজন যৌনাবেদনময় ছেলেকে দেখে যৌন উত্তেজনায় ভুগতে পারেন। তবে যেহেতু আমাদের দেশে নারীরাই পুরুষদের দ্বারা ধর্ষনের স্বীকার হচ্ছে, নিপড়ীত হচ্ছে তাই মেয়েরা তাদের এই যৌনাকাংখা কিভাবে নির্লিপ্ত করে সেটা আপাতর প্রাসংগিক নয়। আমাদের দেশে এখন গ্রামে গঞ্জে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ইদানিং বেশ সহজলভ্য হয়েছে যেমন হয়েছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পর্ন এখন খুবই সহজলভ্য একটি বিষয়। বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে ছেলেপেলেরা মোবাইলে বিভিন্ন সময়ে মোবাইল পর্নোগ্রাফি দেখছে। তারা দেখেছে, কিভাবে মেয়েরা প্রেমের ফাদে পাড়া দিয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, আবার কিভাবে সেটার ভিডিও ফুটেজ বের করা হয়েছে। তারা এটাও জানে এই সবক্ষেত্রে পুলিশের ভুমিকা ঠুটো জগন্নাথ এর মত। আইন থাকলেও কোন প্রয়োগ নেই। নেই কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদহারনও। ফলে তারা উৎসাহিত হয়ে নারীদেরকে প্রেমের ফাদে ফেলতে চায় আর যদি সফল না হয় তাহলে বিফলে মূল্য ফেরতের মত বিফলে ধর্ষন করে তারা।
তাছাড়া আমি মনে করি আমাদের দেশে ধর্ষন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারন হলো রুট লেভেলে সঠিক বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকাটা। এখানে বিনোদনের নামে নানা অপসংস্কৃতি ঢুকে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে। যেমন কিছুদিন আগেই সিরাজগঞ্জের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম চায়ের দোকানে একটি ‘জিসম’ নামে একটি হিন্দি সিনেমা দেখানো হচ্ছে। শিশু থেকে নিয়ে বৃদ্ধরা পর্যন্ত বসে বসে সিনেমাটি দেখছেন। এই ধরনের সিনেমা অবশ্যই একজন শিশু বা তরুনের সুষ্ঠ মানসিক বিকাশকে ব্যহত করে। তরুনরা বিজাতীয় সংস্কৃতির অনেক কিছুই দেখে প্রলুব্ধ হচ্ছে। অনেকের স্বাভাবিক যৌনবাসনা গুলো রুপ নিচ্ছে অবদমিত কামে। একপর্যায়ে এই অবদমিত কামই তাকে ধর্ষকে পরিনত করছে।
ধর্ষন এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটঃ
ধর্ষন পৃথিবীর প্রাচীনত অপরাধগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশও ধর্ষক নামক ঘৃন্য নরপশুদের হাত থেকে মুক্ত নয়। অধিকার নামক একটি মানবঅধিকার সংস্থার প্রতিবেধন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর এই নয় মাসে ৩৩৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ১৫৮ জন নারী ও ১৮০ জন মেয়ে শিশু। ১৫৮ জন নারীকে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে আর ৬৮ জন গনধর্ষনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছর এ পর্যন্ত মোট ধর্ষনের ঘটনা ঘটে ২৪৮টি, গনধর্ষন হয় ১১৬টি, ধর্ষনের পর হত্যা ৮৭টি।
তবে এত সব ধর্ষন ঘটনার প্রেক্ষিতে যে প্রতিবাদগুলো হয়েছে তার প্রায় সবই হয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারগুলো ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। যতদূর মনে পড়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল মাত্র দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষন এবং হত্যা নিয়েই সামাজিক একটি আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু তারপর আরো হাজারখানেক ধর্ষনের ঘটনা ঘটলেও তেমন বড় আকারের তেমন কোন সামাজিক আন্দোলন ঘটে নি।
সেইক্ষেত্রে ভারতকে ধন্যবাদ। তাদের সচেতনতা দেখে আমরাও আজকে সচেতন হয়েছি। মিডিয়াতে ধর্ষনের খবর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ফলে আমাদের ব্লগাররা সবাই ব্লগে এবং ব্লগের বাইরে সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। দেরীতে হলে অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে।
যারা এই বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন করছেন তারা অনেকেই ধর্ষনের শাস্তির হিসাবে একমাত্র মৃত্যুদন্ডের কথা বলেছেন। আমি আইনের লোক নই, তবে পোষ্টটি তৈরী করার সময় যে দু চারজন আইনজীবী বন্ধুর সাথে কথা বলেছি, তাতে বুঝা গিয়েছে এই সংক্রান্ত একটি কঠোর আইন ইতিমধ্যে প্রনয়ন করা হয়েছে এবং এই সংক্রান্ত সকল বিচার স্পেশাল ট্রাইবুন্যালের মাধ্যমেই হয়। আপনাদের জানার সুবিধার জন্য নিচে ধর্ষনের শাস্তির বিধান তুলে দিলাম।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০(সংশোধনী ২০০৩) অনুসারে শাস্তির বিধান
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) – এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের অপরাধের যে সকল শাস্তির বিধান রয়েছে তা হলো:
(১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন৷
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার নিষেধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন৷
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন৷
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-
(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন ;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে ব্যক্তি অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন৷
(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বত্সরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন৷
এছাড়া উল্লেখ্য যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন- ২০০০ এর ৩২ ধারা মতে ধর্ষিতা নারী ও শিশুর মেডিকেল পরীক্ষা ধর্ষণ সংঘটিত হবার পর যত শীঘ্র সম্ভব সম্পন্ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এতে অবহেলা করলে আদালত চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও শাস্তির বিধান রেখেছেন।
তথ্যসূত্রঃ তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ দন্ড বিধি , জাতীয় ই-তথ্যকোষ
আমরা সবাই ধর্ষন নিয়ে কঠিন শাস্তির কথা বলছি। আমরা চাই ধর্ষনের জন্য আরো কঠিন শাস্তির বিধান করা হোক, যেমন একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড যদিও প্রচলিত আইনে মোটামুটি কঠোর একটি আইনের বিধান রয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে সেই আইনটি প্রয়োগ হয় না। আপাতত ভাবে আপনার আমার সামাজিক দায়িত্ব হলো, এই আইন এর প্রয়োগের জন্য জন সচেতনতা সৃষ্টি করা।
পাশাপাশি যদি কেউ ধর্ষনের শিকার হন তাহলে তার করনীয় সম্পর্কে ধারনা দেয়া। যেমন, অধিকাংশ সময়ে আমাদের দেশের মেয়েরা ধর্ষনের শিকার হলে তারা প্রথমেই যে কাজটি করেন তা হলো বার বার গোসল করে নিজেকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। অথচ এই কাজটি করলে ফরেনসিক রিপোর্টে যে প্রমান পাওয়া যায় তা মুছে যায়। যদিও ধর্ষনের শিকার হওয়া একটি মেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই মানসিক ভাবে এতটা শক্ত থাকেন না যে সকল কাজ গুছিয়ে করতে পারবেন। কিন্তু যেহেতু আমরা সচেতনতার কথা বলছি, সেখানে এটা অবশ্যই আমাদেরকে জানাতে হবে। কারন প্রমানের অভাবে অনেক প্রমানিত ধর্ষকই পার পেয়ে যায়।
আমাদেরকে বুঝাতে হবে একজন ধর্ষিত মেয়ের কোন অপরাধ নেই, তিনি অপরাধের শিকার হয়েছেন এবং সমাজ তার পাশেই আছে। যদি তিনি তাৎক্ষনিক কোন সহায়তা পান, তাহলে তার শরীর এবং পোষাক থেকেই অপরাধী সনাক্তকরন এবং প্রমানের জন্য যথাযথ আলামত সংগ্রহ করা যাবে। সেই ক্ষেত্রে তিনি যেন কোন ভাবেই পানি দিয়ে বা পোষাক পরিবর্তন করে আলামত গুলো নষ্ট না করেন। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা একজন নির্যাতিত নারীর পরিচয় গোপন রেখেই তাকে ন্যায় বিচার, ধর্ষন পরবর্তী শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা এবং আইনগত সুবিধা দেয়ার কাজ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে মায়া ভয়েস এর সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এরা এমন একটি সংস্থা যারা গত ২০ বছর ধরে যারা মানবাধিকার এবং এ সম্পর্কিত আইনী সহয়তা নিয়ে কাজ করছে।
হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড ডায়াসপোরা ফিলানথ্রোপি অর্গানাইজেশন আছে নাম দৃষ্টিপাত , এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে। এছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা একজন নির্যাতিত নারীকে ন্যয় বিচার এর জন্য সাহায্য করতে পারে।
আমাদের মনে রাখা উচিত ধর্ষনের প্রতিবাদ করা যেমন আপনার আমার নৈতিক দায়িত্ব, তেমনি এই সংক্রান্ত সকল আইনের কথাও মানূষকে জানানো আপনার আমার সামাজিক দায়িত্ব। আমি বিশ্বাস করি, ভার্চুয়াল এবং বাস্তবে দুই খানেই আমাদের সমান ভাবে কাজ করতে হবে। যে যেভাবেই কাজ করি না কেন, তার অবদানকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। যারা ব্যক্তিগত কোন কারনে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও আসতে পারছেন না, তাদের মন খারাপ করার বা হতাস হবার কিছুই নেই। সামাজিক আন্দোলন শুধু রাস্তায় নেমে করলেই হবে না। অনলাইনেও অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। তবে যারা সকল বাধা বিপত্তি দূর করে নিজের মধ্যকার জড়তা দূর করে রাজপথে সামাজিক অধিকারের আন্দোলন করছেন তাদের সবাইকে আমার অনেক আন্তরিক শুভেচ্ছা। কারন তারা অগ্রগামী। তারা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবিদার। তবে আমাদের কারো আচরন যেন কখনই কারো সাথে সংঘর্ষিক না হয়। আমাদের আন্দোলন হবে প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সেই সাথে একজন ধর্ষনের শিকার নারী কিভাবে সঠিক আইনি পরামর্শ পেতে পারেন বা তার করনীয় কি সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করা।
পরিশেষে আমি বলতে চাই আমাদের জীবন যাপন এবং আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার মাপ কাঠি হওয়া উচিত আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ধারক ও বাহক। আমরা চাই না কেউ তার ব্যক্তি স্বাধীনতার বা ব্যক্তি অধিকারের অপব্যবহার করুক। আমরা চাই না আমাদের দেশের আর কোন মেয়ে ধর্ষনের শিকার হোক। আমরা চাই না আমাদের দেশের কোন নারী মাথা নিচু করে চলুক। রাস্তায় আতংক নিয়ে চলুক। আমরা চাই নারী পুরুষের সহ অবস্থান এবং তা প্রচলিত সুষ্ঠ ধারার ভিত্তিতে।
Discussion about this post