এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সু্প্রীম কোর্ট
নারী ও শিশু নির্যাতন
বাংলাদেশের জনসংখ্যা, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ঘাটতির কারণে দেশে ভায়োলেন্স এগেইন্সট ওমেন এন্ড চাইলড ইজ এ ভেরিকমনসিনারিও। এছাড়া যৌনহয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা এবং ধর্ষণ সহ অপহরণের ঘটনাও খুব অহরহই ঘটছে।
লোক লজ্জার ভয়ে যেগুলোর অধিকাংশই ধামাচাপা পড়ে যায় বা কখনো হয়তো খবরেও আসেনা। নারী ও শিশুদের প্রটেকশনের জন্য বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রচলিত আইন রয়েছে, এছাড়া কিছু ইন্টারন্যাশনাল প্রটোকল ও বাংলাদেশ রেটিফাই করেছেঃ-
১. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০; যেটি পরবর্তীতে ২০০৩, ২০১৩ এবং ২০২০ সালে সংশোধিত হয়। (৩৪ টি ধারা)
২. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ (৩৭ টি ধারা)
৩. শিশুআইন, ২০১৩; যেটি পরবর্তীতে ২০১৮সালে সংশোধিত হয়। (১০০ টি ধারা)
৪. বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭( ২২টি ধারা)
৫. যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮( ১১টি ধারা )
৬.Convention On the Elimination of All Forms of discrimination Against Women , 1979 ( CEDAW)
৭. Convention On The Rights Of the Child, 1989 (CRC)
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০:
এই আইনে নারী পাচার, শিশু পাচার, নারী ও শিশু অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যু, নারীর আত্ম হত্যায় প্ররোচনা, যৌননিপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ভিক্ষা বৃত্তির উদ্দেশ্যে শিশুকে অঙ্গহানি, ধর্ষণের ফলে জন্ম লাভকারী শিশুর অধিকার ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধান।
এই আইনের অধীন কোন অপরাধীর বিচারের জন্য প্রতিটি জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০১ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশু টির তত্বাবধান করবেন শিশুটির মা অথবা মা-পক্ষের আত্মীয় স্বজন। এ সময় শিশু টি মায়ের অথবা বাবার অথবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হবে। আরো বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক অবস্থায় শিশুটির ভরণপোষণ ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে ধর্ষণ কারীকে শিশুর ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হবে।
ধর্ষক ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলেতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ব্যয় ভার বহন করা হবে। সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতানারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ করা যাবেনা বা এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে তাদের পরিচয় প্রকাশ না পায়। এই আইনের অধীন কেউ মিথ্যা মামলা দায়ের করলে ১৭ ধারা অনুযায়ী তার ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও অর্ধদন্ড হতে পারে।
১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে।এই আইনটি সর্বশেষ সংশোধিত হয় ২০২০ সালের ২৬শে নভেম্বর, উক্ত সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড নির্ধারণ করা হয়।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০:
Convention On the Elimination of All Forms of discrimination Against Women , 1979 ( CEDAW) & Convention On The Rights Of the Child, 1989 (CRC) এবং বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যে এই আইনটি প্রনয়ণ করা হয় ।
আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা বলতে, পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অন্য কোনো নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝাবে।
এই আইনের বাস্ত বায়নকারী হলো পুলিশ অফিসার, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।করোনা কালে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর মতে, বর্তমান করোনা কালে পারিবারিক সহিংসতা ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিশুর প্রতি সহিংসতা ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য। এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুরক্ষা আদেশ। আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী প্রতিপক্ষ যদি আদালতের কোনো সুরক্ষা আদেশ বা আদেশে উলেখিত কোনো শর্ত লঙ্ঘনকরে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হইবে।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই আইনটি বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আইনটিকে বাস্তবিক অর্থে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানকরা প্রয়োজন। এই আইন প্রণীত হলেও দেশের অনেক জেলায় চিফজুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গত ১০ বছরে এই আইনের অধীনে কোনো মামলা হয়নি।
শিশু আইন, ২০১৩:
শিশু আইন অনুযায়ী অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে। অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, অপরাধে জড়িত থাকা শিশুর বিচার শুধু শিশু আদালতে ইহবে। অপরাধ সংঘটনের তারিখ হইবে শিশুর বয়স নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক তারিখ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আদালত হিসাবে গণ্য হবে। বাংলাদেশে প্রায় ১০২টি শিশু আদালত রয়েছে।
শিশু আইন প্রনয়নের মূল লক্ষ্যই ছিল শিশু (আসামি, ভিকটিম ও সাক্ষী)-দের সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আদালতে শিশু বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিশু-আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোন কর্মচারী আদালত কক্ষে তাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করিতে পারবেন না। শিশু-আদালত উক্ত আদালতে শিশুর প্রথম উপস্থিত হবার তারিখ হইতে ৩৬০ (তিনশতষাট) দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করবে।
সম্প্রতি শিশু অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এতদিন যে নানা রকমের অসঙ্গতি ছিল, সেসব দূরকরেরায় দিয়েছেন দেশের উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. রুহুলকুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ। আদালত রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘শিশুদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো সাক্ষ্যগত মূল্যই নেই। অপরাধ যাই হোক, শিশুকে ১০ বছরের বেশি দন্ড দেয়া যাবেনা।’
রায়ের তিনটি সিদ্ধান্ত হলো- শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো সাক্ষ্যগত মূল্য নেই। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কোনো শিশুকে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা। অপরাধ যাই হোক না কেন একজন শিশুকে ১০ বছরের বেশি সাজা নয়।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭:
বাল্যবিবাহ অর্থ এইরূপ বিবাহ যার কোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ অপ্রাপ্তবয়স্ক। বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ বছরের নিচে কোন পুরুষ এবং ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ে কে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হবে।
প্রাপ্তবয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্য বিবাহ করলে ২ (দুই) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড।
অপ্রাপ্তবয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে তিনি অনধিক ১ (এক) মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা জরিমানা।
পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোন ব্যক্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হইয়া বাল্য বিবাহ সম্পন্ন করলে ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড।
কোন বিবাহ নিবন্ধক বাল্য বিবাহ নিবন্ধন করলে ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড।
কোনবিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবংপিতা-মাতাবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বাল্য বিবাহ সম্পন্ন করা যাবে।
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮:
‘যৌতুক’’ অর্থ বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষেরনিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবাহের সময় বাতৎ পূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা কালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহেরপণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বাবিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষেকে প্রদত্তবা প্রদানেরজন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রীবা অন্য কোনো সম্পদ, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেনা।
যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহলে ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশহাজার) টাকা অর্থদন্ড।যৌতুকের মিথ্যা মামলা দায়ের করলে অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশহাজার) টাকা অর্থদন্ড।
লকডাউন/করোনাকালীন সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন
লকডাউনে অনেক কিছু থেমে থাকলেও থেমে ছিলনা নারী ও শিশু নির্যাতন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছরের লকডাউন ও পরবর্তী করোনাকালীন সময়ে দেশে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১২ জন নারী।
এছাড়া এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ জন নারী। এরমধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ জন এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্ম হত্যা করেছেন ৭৪ জন নারী। এছাড়া এ সময়ে ১ হাজার ৭৮ জন শিশু শারীরিক নির্যাতন সহ নানা সহিংসতার শিকার হয়। এছাড়া ৬২৭টি শিশু ধর্ষণ ও ২০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটে।
Discussion about this post