অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান:
মাইশা বেগম, আমাদের একজন বোন। পেশায় আইনজীবী। স্বামী মোহাম্মদ খালেদ পেশায় একটি বিদেশী কোম্পানীতে কর্মরত পিএইচডি ডিগ্রীধারী কনসালটেন্ট। বেতন প্রায় লক্ষাধিক টাকা। তাদের সংসারে ৩টি পুত্র ও ১টি কন্যা সন্তান রয়েছে। প্রতিপক্ষ স্বামী প্রায়ই স্ত্রী ও সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন মর্মে সম্প্রতি মাইশা তার স্বামীর বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে পারিবারিক সহিংসতা আইনে দায়েরকৃত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে আনীত মামলায় বাদীনি উক্ত আইনের ১০ ধারায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকার কারনে অংশীদারী বাসগৃহে সহিংসতার কারনে বসবাসের অধিকার খর্ব হওয়ার আশংকায় ১৪ ধারায় সুরক্ষা আদেশের প্রার্থনা করেন কেননা স্বামী আবেদনকারী স্ত্রীর অংশ তার নামে লিখিয়ে রেজিষ্ট্রি নিতে চাপ সৃষ্টি করে আসছিলেন। যার মাধ্যমে ১৫ (ক)(খ) ধারায় আবেদনকারী বাস গৃহের যে অংশে বসবাস করেন সে গৃহে বা অংশে প্রতিপক্ষকে বসবাস বা যাতায়ত করার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং তাকে বাসগৃহের উক্ত অংশ হতে বেদখল বা ভোগ দখলে কোনরূপ বাধা সৃষ্টি সংক্রান্ত কার্য হতে প্রতিপক্ষ স্বামীকে বারিত করার আদেশ প্রার্থনা করেন।
আদালত আবেদন পত্রের সাথে উপস্থাপিত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে পারিবারিক সহিংসতা ঘটার সমূহ আশংকা থাকায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অন্তরবর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ জারী করেন এবং কেন স্থায়ী সুরক্ষা আদেশ প্রদান করা হবে না মর্মে নোটিশ প্রাপ্তির ৭ (সাত) কার্য দিবসের মধ্যে তার কারন দর্শানোর জন্য প্রতিপক্ষকে নির্দেশ দেন। সন্তানরাও বিবাহযোগ্য হওয়ার পরও একটি উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে পারিবারিক সহিংসতার স্বরূপ কেমন হতে পারি মামলাটির অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছি যা এখানে বিস্তারিত তুলে ধরার অবকাশ নেই। এখানে আজ প্রসংগক্রমে এ সমস্যা সমাধানে প্রণীত চমৎকার আইনটি নিয়ে জনসচেতনতার স্বার্থে অত্র আলোচনার অবতারনা করেছি। পারিবারিক সহিংসতা বা ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধে আমাদের দেশে তেমন কোন শক্তিশালী আইন ছিল না। ফলে এটি ক্রমান্বয়ে একটি অপ্রতিরোধ্য সংকটে পরিণত হচ্ছিল। এজন্যে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে পারিবারিক সহিংসতা হতে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন কল্পে সরকার একটি নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। গত অক্টোবর’২০১০ মাসের ৫ তারিখ মহান জাতীয় সংসদে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ১৯৮৯ এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত নারী ও শিশুর সম অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে পাশ হয় ‘‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০’’।
এই আইন অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতি করাকে বুাঝায়। শারীরিক নির্যাতন মানে এমন কোন কাজ বা আচরণ করাকে বুঝায়, যা দ্বারা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির জীবন,
স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয় অথবা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিকে অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করা বা প্ররোচনা প্রদান করা বা বলপ্রয়োগও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কোন উক্তি করাকে বুঝাবে যা দ্বারা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হয়রানি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের উপর হস্তক্ষেপ করাও এর অন্তর্ভুক্ত। আর যৌন নির্যাতন অর্থাৎ যৌন প্রকৃতির এমন আচরণও এর অন্তর্ভুক্ত হবে, যা দ্বারা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়। আর্থিক ক্ষতি বলতে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের আদেশে যে সকল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, সম্পদ বা সম্পত্তি লাভের অধিকারী তা হতে তাকে বঞ্চিত করা বা তার নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রদান না করা বা মালিকানাধীন যে কোন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি অনুমতি ব্যতিত হস্তক্ষেপ করা বা বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দান করা। যেমন কোন নারীর বিয়ের সময় প্রাপ্ত উপহার বা স্ত্রীধন বা অন্য কোন দান বা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদ। এআইনে শিশু বলতে বুঝায় যার বয়স ১৮ বৎসর পূর্ন হয়নি।
পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব:
যদি কোন পুলিশ অফিসার কোনভাবে পারিবারিক সহিংসতার সংবাদ প্রাপ্ত হন অথবা পারিবারিক সহিংসতা যে স্থানে ঘটেছে সে স্থানে উপস্থিত থাকার কারণে পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কে তথ্য প্রাপ্ত হন, তাহলে তিনি পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিকে, প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির সুযোগ, প্রয়োগকারী কর্মকর্তার নিকট হতে সেবা প্রাপ্তির সুযোগ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিনা খরচে আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রাপ্তির অধিকার প্রভৃতি সম্পর্কে অবহিত করবেন ও অন্যান্য দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবেন যা আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত।
প্রয়োগকারী কর্মকর্তা কে:
উক্ত আইনের অধীনে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিকে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রত্যেক উপজেলা, থানা, জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য এক বা একাধিক প্রয়োগকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে থাকেন। উক্ত প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হবেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত অন্য কোন কর্মকর্তা। উক্ত প্রয়োগকারী কর্মকর্তা পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাবলী সম্পর্কে আদালতের নিকট প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন, যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। উক্ত প্রয়োগকারী কর্মকর্তা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি যাতে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ (২০০০ সনের ৬নং আইন) অনুসারে বিনা খরচায় আইনগত সহায়তা এবং বিনামূল্যে দরখাস্ত দাখিলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে থাকবেন। সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সম্মতি ও অভিপ্রায় অনুসারে তাকে আশ্রয় নিবাসে প্রেরণ এবং উক্তরূপ প্রেরণের বিষয়টি অধিক্ষেত্র সম্পন্ন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এবং আদালতকে অবহিতকরণ এবং সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করে এর অনুলিপি অধিক্ষেত্র সম্পন্ন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এবং আদালতকে অবহিত করবেন।
সেবা প্রদানকারী এবং তাদের দায়িত্ব:
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর বিধান সাপেক্ষে, সোসাইটি রেজিষ্ট্রেশন এ্যাক্ট ১৮৬০ এর অধীনে নিবন্ধিত কোন স্বেচ্ছাসেবী সমিতি, ১৯৬১ অথবা কোম্পানী আইন, ১৯৯৪ এর অধীন নিবন্ধিত কোন অলাভজনক কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান অথবা এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত কোন অলাভজনক সংস্থ্ বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান যা মহিলা ও শিশুদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণে অন্তর্ভুক্ত এবং তা বাস্তবায়নার্থে আইনগত সহায়তা, চিকিৎসা, আর্থিক বা অন্যকোন সহায়তা প্রদান করে থাকে। উক্ত সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সম্মতির ভিত্তিতে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা নির্ধারিত ফরমে লিপিবদ্ধকরণ এবং সংশ্লিষ্ট অধিক্ষেত্রের আদালত এবং প্রয়োগকারী কর্মকর্তার নিকট অনুলিপি প্রেরণ, সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট অধিক্ষেত্রের প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং থানায় প্রেরণ, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আশ্রয় নিবাসে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা নিকটবর্তী থানাকে অবহিতকরণসহ সরকার কর্তৃক বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন।
সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির অধিকার:
সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার পক্ষে কোন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোন ব্যক্তি প্রতিকার পাওয়ার জন্য অধিক্ষেত্র সম্পন্ন আদালতে আবেদন করতে পারেন। যেমন- যে স্থানে আবেদনকারী বসবাস করেন, যে স্থানে প্রতিপক্ষ বসবাস করেন, বা পারিবারিক সহিংসতা যে স্থানে সংঘটিত হয়েছে বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যেখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে এ আইনের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে অন্তর্বতীকালীন সুরক্ষা আদেশ। সংশ্লিষ্ট আদালত যদি আবেদন পত্রের সাথে উপস্থাপিত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে দেখেন যে, প্রতিপক্ষ কর্তৃক বা তার প্ররোচনায় কোনরূপ পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে বা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে আদালত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অন্তর্বতীকালীন সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারেন এবং কেন স্থায়ী সুরক্ষা আদেশ প্রদনা করা হবে না, নোটিশ প্রাপ্তির ৭ কার্যদিবসের মধ্যে এর কারণ দর্শানোর জন্য প্রতিপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিকে বসবাস গৃহ হতে উচ্ছেদে বা উক্ত গৃহে প্রতিপক্ষের যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারী করতে পারেন।
প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে বিচার:
প্রতিপক্ষের প্রতি উপস্থিতির জন্য নোটিশ জারী করার পর যদি আদালতে প্রতিপক্ষ উপস্থিত না হয় তাহলে আদালত প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে নিষ্পন্নাধীন আবেদন এক তরফাভাবে নিষ্পত্তি করতে পারবেন। আদালত এ আইনের অধীন আবেদন বিবেচনায় যে কোন পর্যায়ে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সন্তানকে তার নিকট অথবা তার পক্ষে অন্য কোন আবেদনকারীর জিম্মায় অস্থায়ীভাবে সাময়িক নিরাপদ হেফাজতে রাখার আদেশ দিতে পারবেন এবং প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে তৎ সন্তানের সাথে নিরাপদ হেফাজতে সাক্ষাৎকার এর সুযোগ দিতে পারেন। সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিকেও সরকারী বেসরকারী আশ্রয় নিবাসে নিরাপদে সাময়িক সময়ের জন্য অবস্থান করতে পারেন।
ক্ষতিপূরণ আদেশ:
সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি হলে বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে পরবর্তীতে পৃথক দরখাস্তের মাধ্যমে আদালতের নিকট ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করা যাবে। এই আবেদন প্রাপ্তির ৬ মাসের মধ্যে আদালত উক্ত আবেদন নিষ্পত্তি করবেন এবং আদালত যেরূপ উপযুক্ত মনে করবেন সেরূপ আর্থিক ক্ষতিপূরন প্রদানের জন্য প্রতিপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারবেন।
আবেদন নিষ্পত্তি ঃ ক্ষতিপূরণ আদেশের আবেদন ব্যতীত, প্রতিটি আবেদন নোটিশ জারীর তারিখ হতে অনধিক ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে আদালত নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। আবেদন খারিজ হলে বিধি সাপেক্ষে আবেদনকারী ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন পুনরুজীবিত করার আবেদন করতে পারেন। এই আইনে চীফ জুড়িশিয়াল বা সি.এম.এম. আদালতে আপীলের বিধানও রয়েছে।
সুরক্ষা আদেশ লঙ্ঘনের শাস্তি:
সুরক্ষা আদেশ বা এর কোন শর্ত লঙ্ঘন করলে ১ম বার অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট অপরাধী ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হবে। পরবর্তী প্রত্যেকবার অপরাধের জন্য অপরাধী ২ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। এই আইনে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে ১ বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আলোচ্য আইনে। আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোন আদেশ যদি প্রয়োগকারী কর্মকর্তা পালন করতে অস্বীকার, গাফেলতি করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে তবে এব্যাপারে তাকে কারন দর্শানোর সুযোগ দিতে হবে। এ আইনে হাসপাতাল,ক্লিনিক বা চিকিৎসা কেন্দ্রে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির চিকিৎসা সেবারও নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এ আইনের অধীনে প্রদত্ত সকল আদেশের অনুলিপি আদালত পক্ষগণ, সংশ্লিষ্ট থানার ও.সি, প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারীকে বিনামুল্যে সরবরাহ করবে। এ আইন পক্ষগণের আবেদন ও সম্মতির ভিত্তিতে বা আদালত স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে এ আইনের অধীনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে (ট্রায়েল ইন ক্যামেরা) বিচারকার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। এ আইনের অধীনে সংগঠিত সকল অপরাধ আমলযোগ্য , জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য।
উপরের আলোচনায় দেখলাম পারিবারিক সহিংসংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এ ৬০ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তির এবং মামলার বিচার ক্যামেরা ট্রায়েল বা বিচারকের খাস কামরায় অনুষ্ঠানের বিধানও রয়েছে। এ আইনটিতে কিছু ভুল ত্র“টি সীমাবদ্ধতা থাকলেও সরকারের এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। কেননা দীর্ঘ দিন যাবৎ পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে একটি আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজ জোর আওয়াজ তুলে আসছিল। ভবিষ্যতে বাস্তব প্রয়োগের অভিজ্ঞতার আলোকে এ আইন সংস্কারের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে একথা জোর দিয়ে বলা যায়। তবে এ-সুন্দর চমৎকার সুরক্ষা পদ্ধতি সহ ক্ষতিপূরন প্রদানের এবং অন্তবর্তীকালীন আদেশ সম্বলিত আইনটি যাতে অপব্যবহারের কারনে মুখ থুবরে বা অকার্যকর হয়ে না পড়ে সেজন্য সকলকে সর্তক থাকতে হবে। এটা যেন মামলাবাজদের হাতিয়ারে পরিনত না হয়। শুধু আইন দিয়ে পারিবারিক সহিংসতা রোধ করা সম্ভব নয়। এজন্যে আমাদের মাঝে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। একটি পরিবার থেকে সকল প্রকার বৈষম্য, বঞ্চনা ও নির্যাতনকে নির্বাসন দিয়ে নির্যাতনমুক্ত পরিবার গড়ে তুলতে পারলে তাহলে আইনের কঠোর প্রয়োগের কোন প্রয়োজন পড়ে না। মা বাবা, স্বামী স্ত্রী, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন সকলে মিলেমিশে নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়ে অধিকারের পাশাপাশি পরস্পর দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন হলে একটি সহিংসতামুক্ত পরিবার গড়ে তোলা যায়। এজন্যে আমরা যারা সচেতন নাগরিক ও সমাজকর্মী আমাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে এ ব্যাপারে ‘‘আমরাই পারি’’ শীর্ষক ক্যাম্পেইন চালু করতে হবে।
আমাদের বন্ধুরা যারা নারী সম্পর্কে কিংবা স্বামী স্ত্রীর সর্ম্পক নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে আমরা তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে তাদের ধারণা বদলানোর চেষ্ঠা করতে পারি। এ ব্যাপারে স্কুল কলেজসহ ক্লাব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমরা আমাদের বাবা মা ভাই বোন পরিবারের সকলেই মিলে প্রতিজ্ঞা করতে পারি আমাদের পরিবারে নারী এবং পুরুষের মর্যাদা সমান হবে। আমাদের পরিবারে কোন বৈষম্য থাকবে না। মানসিক কিংবা শারীরিক নির্যাতনমুক্ত পরিবার গঠনের মাধ্যমে এভাবে আমরা পর্যায়ক্রমে একটি নির্যাতনমুক্ত গ্রাম, শহর ও দেশ গড়ে তুলতে পারি। আমাদের দেশে বিভিন্ন পরিবারে নারী ও শিশুদের মারাত্মক অবজ্ঞা ও অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। বিশেষ করে পরিবারের কন্যা শিশুরা সর্বক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার।
গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করতে গিয়ে অনেকইে গৃহ কর্তার যৌন লালসার শিকার হয় অনেক ক্ষেত্রে। নতুন আইনে তাদের এবং গৃহ শিক্ষকও যাতে ছাত্র-ছাত্রী নির্যাতনের দায় থেকে পার না পায় তার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ ছিল। তাছাড়া নারী শিশুর পাশাপাশি পরিবার অবহেলিত নির্যাতিত বৃদ্ধবৃদ্ধাদেরও এ আইনে সুরক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হতো। তবে এ আইনে মিথ্যা বক্তব্য সম্বলিত যৌতুকের মামলা কমে যাবে। কেননা এ-আইনে যৌতুকের জন্য নির্যাতন ব্যতীত যে কোন শারীরিক মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনী প্রতিকার রয়েছে। এ ধরনের অপরাধ গুলোর ইতিপূর্বে বিচার করা খুব দুরূহ ছিল। নতুন আইন প্রণয়নের ফলে সে সংকট উত্তরণ হবে এবং আইনের ফাঁক ফোকড় দিয়ে কেউ পালাতে পারবে না আমার বিশ্বাস।
তবে সবচেয়ে ভাল হয় বিবেকবোধ জাগ্রত করা এবং সচেতনতার মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ করা। শুধুমাত্র আইন দ্বারা এই অপরাধ প্রতিরোধ করতে গেলে পারিবারিক বন্ধন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তাই সচেতন নাগরিকদের কাছে আহবান জানাবো আসুন আইন প্রয়োগের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলি যাতে করে একটি নির্যাতনমুক্ত সুখী সমৃদ্ধশালী সুশাসন বান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। তবেই বোন মাইশাদের স্বামীর মতো আপনজনের বিরুদ্ধে আদালতে দাঁড়াতে হবে না।
– অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান
Discussion about this post