বিয়ে ও পরিবারের মতো গুরুত্ত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক কে সুরক্ষা দিতেই ১৮৬০ সালে দণ্ডবিধির এই ৪৯৭ ধারার উৎপত্তি। কিন্তু কালক্রমে এই ধারাটি অকেজো এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। দেড়শ বছরের পুরনো এই আইনের সংশোধন এখন সময়ের দাবি নিয়ে লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সম্মানিত সহকারী অধ্যাপক জনাব- সাঈদ আহসান খালিদ।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘পরকীয়া’ ও ‘ব্যভিচার’- এই দুটো শব্দ আমরা হামেশা গুলিয়ে ফেলি এবং সমার্থক মনে করি যা আদতে বেঠিক। আইনি দায় নির্ধারণের পূর্বে দুটোর তফাৎ জানা জরুরি।
‘পরকীয়া’ বলতে অন্যের স্বামী বা স্ত্রীর সাথে বিবাহবহির্ভূত প্রেম বা প্রণয় কে বুঝায়, ইংরেজিতে আমরা বলি- ‘Extra Marital Affair’ । এখন এই প্রেম যৌন সঙ্গম অব্দি গড়াতেও পারে আবার নাও পারে। অর্থাৎ, পরকীয়া ব্যভিচারসহ বা ব্যভিচারহীন দুটোই হতে পারে। পরকীয়া ‘অনৈতিক’ হলেও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী ব্যভিচারের পরিণতি না পাওয়া পর্যন্ত ‘অপরাধ’ হিসেবে পরিগণিত হবে না। তার মানে যৌন সঙ্গমহীন বিবাহবহির্ভূত পরকীয়া আইনে অপরাধ নয় এবং এই পরকীয়ার অভিযোগে কাউকে দায়ী করা যায় না।
অপরের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম সংঘটিত হলে তখন সেটি আইনের ভাষায় ‘ব্যভিচার’ বা ‘Adultery’ হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারানুযায়ী ‘ব্যভিচার’ আইনের চোখে অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। চলুন, দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা পড়ে দেখি-
“‘কোনো পুরুষ যদি জেনেশুনে কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে তার স্বামীর সম্মতি না নিয়ে বা তার অজান্তে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন, এবং অনুরূপ যৌন সঙ্গম যদি ধর্ষণ না হয় তাহলে তা ব্যভিচারের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং শাস্তিস্বরূপ সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা কিংবা উভয়ই প্রযোজ্য হতে পারে। এক্ষেত্রে ওই বিবাহিত স্ত্রী অপরাধের সহযোগী রূপে কোন শাস্তি পাবে না”
এই ৪৯৭ ধারায় কাউকে শাস্তি প্রদান করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হবেঃ
▷ প্রথমত, আসামি কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করেছিল,
▷ দ্বিতীয়ত, ওই নারী বিবাহিত ছিল এবং তার স্বামী বর্তমান,
▷ তৃতীয়ত, অভিযুক্ত বিবাহের বিষয়টি জানত এবং তা বিশ্বাস করার কারণও ছিল,
▷ চতুর্থত, ওই যৌন সঙ্গম নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে হয়েছিল,
▷ পঞ্চমত, ওই যৌন সঙ্গম নারী ধর্ষণের শামিল ছিল না অর্থাৎ, সঙ্গমে ওই নারীর সম্মতি ছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই ধারানুযায়ী ব্যভিচারের অপরাধে দায়ী হবে শুধু ব্যভিচারী পুরুষই, ব্যভিচারে লিপ্ত স্ত্রীলোকটির কোন আইনি দায় নেই এবং দুষ্কর্মের সহযোগী (Abettor) হিসেবে তার কোন শাস্তি হবে না। “ব্যভিচার প্রমাণিত হলেও স্ত্রীলোকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যাবেনা”- ৪৯৭ ধারার এই ব্যাখ্যা ১৯৭৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের এক সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশানে (PLD) সন্নিবেশিত আছে।
দেড়শো বছরের পুরনো এই ব্যভিচার আইনে আজ অব্দি কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির এই ৪৯৭ ধারা নিম্নোক্ত কারণে অসম্পূর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্যমূলক, সেকেলে এবং বর্তমান সময়ের উপযোগী নয়ঃ
পুরুষ ব্যভিচারী এবং বিবাহিত নারীটি ঘটনার শিকার- দেড়শো বছরের পুরনো সামাজিক সেই বাস্তবতা বর্তমানে অসার। সম্প্রতি ভারতের সুপ্রীম কোর্ট প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র ব্যভিচার সংক্রান্ত এক মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারার এই বিধানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন- ‘যদি কোনো বিবাহিতা নারী পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তার দায়-দায়িত্ব ওই পুরুষের যেমন, তেমনি ওই নারীরও। সেই দায়িত্ব তো নারীটিকে নিতেই হবে। সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম, তার ফল ভোগ করলাম, কিন্তু দোষী হলো শুধু পুরুষ, সেটা তো ঠিক নয়।”
ব্যভিচারে লিপ্ত নারী-পুরুষের মধ্যে নারীটির অন্যের “বিবাহিত স্ত্রী” হওয়াটা এই ধারায় একটি শর্ত, ব্যভিচারী পুরুষটির বিবাহিত হওয়াটা শর্ত নয়। ৪৯৭ ধারার এই অংশটি অসম্পূর্ণ এবং ধর্মীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের আইনানুযায়ী একজন অবিবাহিত পুরুষ ও অবিবাহিত নারী কিংবা একজন বিবাহিত পুরুষ ও অবিবাহিত নারীর মধ্যকার পারষ্পরিক সম্মতিমূলক যৌন সঙ্গম ও একত্র বসবাস আইনসম্মত এবং তা ব্যভিচার বলে গণ্য হয় না।
৪৯৭ ধারার ব্যাখ্যানুযায়ী একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে একজন অবিবাহিত, বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্ত নারীর মধ্যে যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক হয়, তাহলে তা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না এবং ওই লোকের স্ত্রীটি অভিযুক্ত স্বামী কিংবা পরকীয়ায় লিপ্ত নারীটির বিরুদ্ধে কোন আইনগত প্রতিকার পাবে না।
৪৯৭ ধারা অনুযায়ী, স্বামীর “সম্মতি” (Consent) নিয়ে বা জ্ঞাতসারে (Connivance) তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর সাথে অন্য পুরুষ যৌন সঙ্গম করলে তা ব্যভিচারের সংজ্ঞায় পড়বেনা। স্ত্রীর সম্মতি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ব্যভিচারে বিবাহিতা মহিলার স্বামীর সম্মতি থাকা মানে কী? স্ত্রী কি স্বামীর সম্পত্তি না পণ্য? আবার দৃশ্যের অন্যপিঠও আছে- এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের “আমি সে ও সখা” গল্পটি প্রণিধানযোগ্য যেখানে স্বামী মনে করেছেন বিবাহিত জীবনের স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরে রাখতে সে অক্ষম ৷ তাই স্বামী প্রতিবাদহীন মেনে নিয়েছে- অন্য পুরুষের সঙ্গে যদি তাঁর স্ত্রী ভালো থাকে, তো থাকুক৷ এই প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ব্যভিচারের অভিযোগ হালে পানি পাবেনা।
পরকীয়া ও ব্যভিচার একটি সামাজিক অনাচার, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। বিয়ে ও পরিবারের মতো গুরুত্ত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক কে সুরক্ষা দিতেই ১৮৬০ সালে দণ্ডবিধির এই ৪৯৭ ধারার উৎপত্তি। কিন্তু কালক্রমে এই ধারাটি অকেজো এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। দেড়শ বছরের পুরনো এই আইনের সংশোধন এখন সময়ের দাবি।
–সাঈদ আহসান খালিদ
আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post