মো. জাহিদ হোসেন:
ঘর থেকে রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক ও অলিগলিতে নানা রঙের পোস্টার। আর সেই সঙ্গে দেখা যায়, যত্রতত্র নানা রকম দেয়াললিখন ও বিলবোর্ড। কোথায় নেই পোস্টার, বিলবোর্ড ও দেয়াললিখন! বাসস্থান, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, দোকান থেকে শুরু করে দেয়াল, বেড়া, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, খাম্বা, সড়ক বিভাজক, ব্রিজ, কালভার্ট কিংবা সড়কের উপরিভাগ সব স্থানেই হরদম চলছে দেয়াললিখন, পোস্টার লাগানো আর বিলবোর্ডের কাজ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার তাদের প্রচার-প্রচারণার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো, বিলবোর্ড সাঁটা আর দেয়াললিখনকে। এতে তাদের প্রচার-প্রচারণা বা বিজ্ঞাপনের জন্য কাউকে কোনো অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে না বিধায় তারা এ ব্যাপারে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাতের আঁধারে মালিকের কোনো অনুমতি ছাড়াই যারতার দেয়ালের ওপর চলছে এসব অবৈধ কাজ।
দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে দেয়াললিখন বা পোস্টার লাগানো নিষেধ থাকলেও এ ক্ষেত্রে কোনো দল, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান_কেউই আইনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করছে না। এমনকি জেলা আদালতের দেয়ালগুলোও রঙিন হয়ে আছে নানা রঙের পোস্টারে। অনিয়ন্ত্রিত পোস্টার, বিলবোর্ড ও দেয়াললিখন যেমনি পথচারীর নিয়মিত বিরক্তির সৃষ্টি করছে, তেমনি নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করার প্রধান অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেয়াললিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২-তে বলা আছে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াললিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে এবং ওইভাবে নির্ধারিত স্থানে দেয়াললিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে দেয়াললিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে।
বিদ্যমান দেয়াললিখন বা পোস্টার সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আইন কার্যকর হওয়ার পর বিদ্যমান দেয়াললিখন বা পোস্টার মুছে ফেলতে বা অপসারণের জন্য সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সময়সীমা নির্ধারণ করবে। কিন্তু সরকার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগী তার দেয়াললিখন বা পোস্টার অপসারণ বা মুছে ফেলতে দেখা যায় না।
সময়সীমা অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে অননুমোদিত যেকোনো দেয়াললিখন বা পোস্টার মুছে ফেলতে বা অপসারণ করতে পারবে এবং এসব কাজের সব খরচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগীর থেকে নগদ আদায় করবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগী কোনো অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করতে না পারলে তা Public Demands Recovery Act, 1913 (Act IX of 1913)-এর বিধান অনুযায়ী সরকারি দাবি হিসেবে আদায় করা যাবে।
নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোনো দেয়াললিখন বা পোস্টার মুছে ফেলা না হলে বা অপসারণ করা না হলে কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে নগদ অর্থ আদায় করা না গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে। অনাদায়ে অনধিক ১৫ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে। আর সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে। অনাদায়ে অনধিক ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিতে পারবেন আদালত। এ ছাড়া ওই ব্যক্তি বা সুবিধাভোগীকে তার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াললিখন বা পোস্টার মুছে ফেলার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাবে। বিদ্যমান আইনে দেয়াললিখন বা পোস্টার সম্পর্কিত সব অপরাধের বিচার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে করার বিধান রয়েছে।
কোনো কম্পানি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করলে বা এমন কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে ওই কম্পানির প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ওই অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে, যদি না তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে ওই অপরাধ তাঁর অজ্ঞাতে করা হয়েছে বা ওই অপরাধ রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আইন অনুযায়ী স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেমন_সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা সময় সময় অননুমোদিত দেয়াললিখন বা পোস্টারগুলো মুছে ফেলার বা অপসারণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না।
২০১২ সালে হাইকোর্ট জনগণের ও ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর দৃশ্য দূষণকারী এ ধরনের প্রচারণা রোধ ও নিয়ন্ত্রণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। আইন হলো, রুল জারি করা হলো। তবুও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
তা ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাগানো বিলবোর্ডগুলোও অবৈধ। রাতে এগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে পরোক্ষভাবে নগরবাসীকে বৈদ্যুতিক সংকটে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন হারবাল প্রতিষ্ঠানের অশ্লীল পোস্টারে ছেয়ে গেছে সর্বত্র। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ বা সিটি করপোরেশনকে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আইন থাকলেও আমাদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। যে যার পক্ষ থেকে নিজ নিজ দেয়াল ও স্থান পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে।
লেখক : ছাত্র ও মানবাধিকার কর্মী
আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post