নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রধান বিচারপতির বিদায় উপলক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিদায় সম্ভাষণ পাঠ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সহ- সভাপতি এডভোকেট মুহাম্মদ শফিক উল্লাহ।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর আপীল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক বৃন্দ, বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীবৃন্দ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ট্রেজারার সহ- সম্পাদক সহ সদস্যরা এবং আইনজীবী ভাই ও বোনেরা।
আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি বাংলাদশের প্রধান বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে বিদায় জানানোর জন্য। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপনি এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী আইনজীবী পরিবারে ১৯৫৪ ইং সনের ৩১ শে ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন।
আপনার পিতা সৈয়দ মােস্তফা আলী কুমিল্লা বারের একজন বয়ােজেষ্ঠ আইনজীবী, কুমিল্লা বারে বারের সাবেক সভাপতি এবং সাবেক সরকারী আইনজীবী ছিলেন।
আপনি কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ১৯৭২ ইং সনে সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।আপনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ থেকে ১৯৭৪ ইং সনে হাইয়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।আপনি ঐ একই কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ১৯৭৬ ইং সনে বি.এস সি ডিগ্রী লাভ করেন। আপনি ১৯৮০ ইং সনে কুমিল্লা ল’ কলেজ থেকে ল‘ ডিগ্রী লাভ করেন।
আপনি ১৯৮১ইং সনে আইন পেশায় যােগদান করেন এবং ১৯৮৩ সনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এনরােল্ড হন। আপনি বিদেশেও লেখাপড়া করেন।আপনি Studied in the School of Oriental African Studies (SOAS) এবং Institute of Advanced Legal Studies of London এ ৬ মাসের কমনওয়েলথ Young Lawyers’ কোর্স সম্পন্ন করেন।
আপনি ১৯৯৯ ইং সনে ডেপুটি এটর্নী জেনারলে নিযুক্ত হন এবং ২২/০২/২০০১ ইং তারিখে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিয়ােগ লাভ করেন এবং ২২/০২/২০০৩ ইং তারিখে স্থায়ী বিচারক হিসাবে নিয়ােগ লাভ করেন।
পরবর্তীতে আপনার বিচার কার্যে দক্ষতা, যােগ্যতা এবং বিচারিক সুলভ দায়িত্ব পালনের জন্য আপনি ২৩/০২/২০১১ ইং তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর আপীল বিভাগে নিয়ােগ লাভ করেন।আপনি বাংলাদেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে ০৩.০২.২০১৮ ইং তারিখে নিয়ােগ লাভ করেন।
আপনি বিভিন্ন আন্তজার্তিক সেমিনার, সিম্পােজিয়ামে অংশ গ্রহন করেন। যেমন, মালেশিয়া ,সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ভারত, সাউথ কোরিয়া, কানাডা, ইউ, এস, এ, হংকং এবং ফিলিপাইনসই অনেক দেশে।
আপনার বিচারিক জীবনে অনেক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন।তার মধ্যে নিম্ন লিখিত রায় গুলো উল্লেখযােগ্য –
I) Formulated guidelines on sexual harassment at workplaces ano there is no law on sexual harass of Bangladesh National Won (BNWLA) Vs. Government of Ba 375 and 14 BLC 488.
II) First reported case on DNA test for determination of parentage in the case of Bangladesh Jatiya Mahila Ainjibi Samity Vs. Ministry of Home Affairs and others , reported in 61 DLR (AD) 371.
III) Judgment on environment in the case Metro Makers & Developers Ltd. VS. Bangladesh Environment Lawyers Association Ltd. (BELA) and others , reported in 66 DLR (AD) 181.
IV) On benami transaction, in the case of S. N. Kabir Vs. Fatema Begum and others, reported in 66 DLR(AD) 193.
V) Judgment on fatwa in case of Tayeeb (Md) and others Vs. Government of Bangladesh and others, reported in 67 DLR (AD) 57.
ইহাছাড়া লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে আপনার দেয়া রায় ঐতািসিক ও স্বরণীয় মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপনি উক্ত রায় গুলাে ছাড়া বাংলাদেশের দুইটি ঐতিহাসিক রায় একটি মাসদার হােসেন মামলার রায় আরেকটি ষােড়শ সংশােধনীর রায় আপনার অশেষ অবদান যা জাতী যুগ যুগ ধরে আপনাকে স্মরন রাখবে। এই দুইটি ঐতিহাসিক রায়কে দেশের এবং দেশের বাহিরে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ স্বাগত জানিয়েছে।
এই দুইটি মামলার রায়ের মধ্যে আপনার মেধার বিকাশ লাভ করেছে। আপনি আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবুনালের অনেক মামলার আপীলের রায় প্রদান করেছেন। আপনার এ সাহসিকতার জন্য জাতী আপনাকে স্মরনে রাখবে।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপনি অত্যান্ত দক্ষতার সাথে, ন্যায় পরায়নতার সাথে এবং স্বাধীনভাবে বিচার কার্য পরিচালনা করেছেন এবং হাইকোর্ট বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি হিসাবে আপনি সুপ্রিম কোর্টের কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয়।
আইনজীবীরা এই আদালতে বিচার কার্যের বিষয়ে যখনই আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করেছেন, তখনই আপনি ধৈর্য ধরে শুনেছেন এবং আইনের আওতায় থেকে যথাসম্ভব সমাধানের চেষ্টা করেছেন। আইনজীবীদের প্রতি আপনার ব্যবহার ছিলাে অমায়িক ও আন্তরিক।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপনি সর্বদা বিচারালয়ের উন্নতির চিন্তা করেছেন এবং এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। আপনার নিরলস প্রচেষ্টার জন্যই আজ সুপ্রীম কোর্ট প্রশাসনিক ভবন সমূহ পেয়েছেন এবং একটি অত্যাধুনিক অডিটরিয়াম ব্যবহার করতে পারছেন।
আপনি প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন স্থানে সুপ্রীম কোর্ট জাদুঘর স্থাপন করে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন আপনার এ শুরু করা জাদুঘর ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে এবং আপনার এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ।
আপনি বিচারপতিদের জন্য একটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এ ক্লাব প্রতিষ্ঠার ফলে বিচারপতিগন একের সাথে অপরের যােগাযােগ বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের সম্পর্ক আরও আন্তরিক হবে এবং নিজেদের মধ্যে সহমর্মিতার পরিবেশ আরও উন্নত হবে।
জনাব এ.বি.এম. খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বিচারপতিদের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য কাকরাইলে বহুতল ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, অনেকেরই ধারনা ছিল এ আবাসন প্রকল্প সহসায় বাস্তবায়িত হবে না। এ প্রকল্পটি শুরু করার বিষয়ে আপনার বিভিন্ন পদক্ষেপ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এবং মাননীয় বিচারপতিদের আবাসিক সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে।
আদালতের কাজকে তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়ে UNDP কে সংযুক্ত করে আপনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন বিচার প্রার্থী ও আইনজীবীগণ তার সুফল পেয়েছেন।
ইহাছাড়া বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সময়ে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্টপতি কর্তৃক ২০২০সনের ০১নং অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ নামে যে অধ্যাদেশ জারী করেছেন , তার মাধ্যমে বিচার প্রার্থী জনগণ ও আইনজীবীগণ সুফল পেয়েছেন আপনাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ।
আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধান সমুন্নত রাখার প্রয়াসে আপনি নিজেকে সর্বদা নিয়ােজিত রেখেছেন। যুগান্তকারী কতিপয় রায় প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে চিরস্মরনীয় করে রেখেছেন।
একজন বিচারক হিসেবে আজই আপনার শেষ কার্য দিবস। আমরা এই আসনে আপনাকে আর দেখব না। কিন্তু একজন প্রধান বিচারপতি হিসাবে আপনার কার্যাবলি আমাদের সর্বদা স্মরনে থাকবে।
ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে যখনই প্রয়ােজন হবে আমরা আপনার প্রদত্ত রায় ও সিদ্ধান্ত সমূহের স্মরনাপন্ন হবাে এবং এভাবে সর্বদা আমাদের মানসলােকে আপনার উজ্জ্বল উপস্থিত অনুভব করবাে। আইনজীবী ও একজন বিচারপতিদের মধ্যে তফাৎ এইযে, একজন বিচারপতি বেঁচে থাকেন তাঁর প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে। তিনি তার কাজের মাধ্যমে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান।
আজ এই বিদায় দিনে আমরা আপনার জন্য এই প্রার্থনা করি যাতে আপনি সুস্থ থাকেন এবং আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিত পেয়ে ধন্য হই। আপনি অবসরে গিয়েও যেন আমাদের আইনের ভুবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেন। অবশেষে আপনার সুস্বাস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করে এই বিদায় ভাষন শেষ করছি। আল্লাহ আপনার সহায় হইক
Discussion about this post