বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এতটাই চাপের মুখে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে দেয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রকৃত কিনা। বিচারকরা দৌড়ের ওপর আছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথিত
মতে তাদের ওপর অসন্তুষ্ট। একজন বিচারক বিদেশে গেছেন। কিন্তু তিনি আর নাও ফিরতে পারেন। কারণ বলা হয়ে থাকে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে নেই।
এটা বোধগম্য যে, যদি তিনি কখনো ঢাকায় ফেরেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কিছু একটা ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলে তার শঙ্কা আছে। সত্যি বলতে কি, সমগ্র বিচার বিভাগ বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
আমি বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে সাফাই বক্তব্য দিচ্ছি না। কিন্তু ওই রায়ের পেছনে শেখ হাসিনার হাত রয়েছে বলে অনুভূতি এতটাই জোরালো যে, রায়টি তার ‘ফেস ভেলু’তে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে না। বিশেষ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে শাস্তিদান কালে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য’ ও সামাজিক মর্যাদা’ বিবেচনায় তাকে তিনি কম মেয়াদি সাজা দিয়েছেন। এর অর্থ হলো তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো বিদেশি অনুদান থেকে পাওয়া তার পরিবারের দ্বারা পরিচালিত জিয়া এতিমখানা পরিচালনার তহবিল থেকে ২১ মিলিয়ন টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। তার সঙ্গে তার ছেলেসহ আরো পাঁচ জন ১০ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড পেয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছেন, জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট কেবল কাগজে কলমে টিকে আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও তার তিন সহযোগী জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট থেকে আরো সাড়ে ৩১ মিলয়ন টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। রায়ের প্রাক্কালে বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তাকে একটি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। তার কথায়, ‘আমি বিশ্বাস করি, সব অভিযোগ থেকে আমাকে রেহাই দেয়া হবে। এটা একটি মিথ্যা মামলা। আমি ও আমার পরিবারকে হয়রানি করার জন্য এসব মামলা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই রায় যদি ক্ষমতাসীন সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তা একটি কলঙ্কিত ইতিহাস সৃষ্টি করবে। খালেদা জিয়া আরো বলেছিলেন, তাকে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করা একটি নজির। তিনি আরো বলেছিলেন, আমি সব ধরনের ফলাফল মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি জেল বা শাস্তিকে ভয় পাই না। অমি আমার মাথা নত করব না। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট যদি ভিন্নতর কোনো রায় না দেন, তাহলে এই রায় তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বিচারিক আদালতের রায় পাওয়ার একদিন পরে রায়কে চ্যালেঞ্জ করে তার আইনজীবীরা হাইকোর্টে আপিল করেছেন। ১২২৩ পৃষ্ঠার আপিল আবেদনে তার আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান খালেদা জিয়া কেন মুক্তি পাবেন তার সপক্ষে ২৫টি যুক্তি দেখিয়েছেন। এর সারকথা হচ্ছে রাজনীতি থেকে তাকে বিদায় দিতেই মামলাটি পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগ শেখ হাসিনার সরকার নাকচ করেছেন। আদালতের কর্মকর্তারা বলেছেন, দুই সদস্যের হাইকোর্ট বেঞ্চে এই আপিলের শুনানি চলতি সপ্তাহের শেষে শুরু হতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাটি হলো তার বিরুদ্ধে দায়ের করা এক ডজন দুর্নীতি মামলার অন্যতম। বেগম জিয়া গত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালে তিনি ইতিমধ্যে একটি সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছেন, আর সেটা তখন বিরাট প্রতিবাদের মুখে পড়েছিল। কিন্তু বেগম জিয়া এবারে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেছেন, বেগম জিয়াকে ছাড়া তাদের দল নির্বাচনে যাবে না। তার কথায়, ‘বেগম জিয়াকে ছাড়া কোনো জাতীয় সাধারণ নির্বাচন হবে না।’ এদিকে শেখ হাসিনার সরকার বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে তাদের কিছু করার নেই। বিএনপি আসুক আর না আসুক, যথারীতি ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
মিডিয়া সমালোচনার মুখে শেখ হাসিনা বলেছেন, ওই দুর্নীতি মামলা বেগম জিয়ার সমর্থকরাই ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করেছিল। ওই সময়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ওই অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিল। তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপি যদি রায়ের কারণে নির্বাচন বর্জন করে তাহলে আমরা তো নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পারি না। ১৯৯১ সাল থেকে বেগম জিয়া তিন বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি এখন ৩০টির বেশি অভিযোগের মুখোমুখি রয়েছেন। এর মধ্যে দুর্নীতি থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আছে। বিএনপি ওই কারাদণ্ড ঘোষণার পরে দ্রুততার সঙ্গে তার ছেলেকে তার পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা এমনকি মন্তব্য করেছেন, এই সিদ্ধান্তে বিএনপির ‘নৈতিক দারিদ্র’ প্রকাশ পেয়েছে। এটা প্রশংসনীয় যে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিচার বিভাগ স্বাধীনতা বজায় রাখছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ সুপ্রিম কোর্টে তাকে দণ্ডিত করার পাশাপাশি বলেছিলেন তিনি আদালত ও সংসদের ভেতরের ও বাইরের জনগণকে বোকা বানোনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কখনই সমগ্র সত্য নিয়ে আদালতের সামনে উপস্থিত হননি।
নওয়াজ শরীফ রায় গ্রহণ করে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি আবার জনগণের কাছে ফিরে যাবেন। ফোডার স্কামে রাচি হাইকোর্টে দণ্ডিত রাষ্ট্রীয় জনতা দল প্রধান লালু প্রসাদ যাদবের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। এ রকম আরো উদাহরণ রয়েছে, যেখানে রাজনীতিকদের পদত্যাগ করতে হয়েছে। এরকম ভুরি ভুরি নজির আছে যেখানে রাজনীতিকরা এমন পরিস্থিতি থেকে পুনরায় ফিরে এসেছেন। রাজনীতিতে নিজদের প্রাসঙ্গিক রাখতে তারা উচ্চ আদালতে নিম্ন আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করেছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় একটা সংস্কার আনা দরকার, যাতে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা চিরজীবনের জন্য রাজনীতিতে অযোগ্য থাকেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ‘সরকারে ‘অপরাধী রাজনীতিকদের’ কোনো স্থান থাকা উচিত নয়। কিন্তু এই বিষয়ে পরিবর্তন আনার দায়িত্ব আদালত নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেছেন। কিন্তু এটা এখনো পর্যন্ত কাজ করেনি। সুপ্রিম কোর্ট কিভাবে আশা করতে পারেন যে, নির্বাহী বিভাগ এটা ভবিষ্যতে করবে?’
(কুলদীপ নায়ার, ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামনিস্ট। লেখাটি ডেকান হেরাল্ডে সমপ্রতি প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ)
– মানবজমিন থেকে সংগ্রহ করেছেন ”মিহির মিশকাত”।
Discussion about this post