আমাদের বৃহওর সিলেটের গৌরব বাংলাদেশের ২য় প্রধান বিচারপতি মরহুম জনাব সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন সাহেব ১৯১৬ সালে হবিগঞ্জ জেলার লস্করপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা ছিলেন সিলেটের শাহানশাহ তরিকতের বাদশাহ হজরত শাহজালাল ইয়ামনী(রঃ)-এর সহযোদ্ধা ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সিপাহশালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রঃ) এর সরাসরি বংশধর ।
মরহুম সৈয়দ এ, বি, মাহমুদ হোসেন সাহেব সিলেটের এম,সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আইএ এবং বিএ পাস করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে ঢাকার নারিন্দা শাহ সাহেব লেনের আল্লাহর ওলী হযরত শাহ আহসান উল্লাহ সাহেবের পুত্র পীর সাহেব শাহ আবদুল আযীযের কন্যা সুফিয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মরহুম জনাব সৈয়দ এ, বি, মাহমুদ হোসেন সাহেব ঢাকার নারিন্দায় দারুল উলুম আহসানিয়া মাদরাসার অবৈতনিক সুপারিনটেন্ডন্ট এর দায়িত্ব কিছু দিন পালন করেন।
তিনি ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করে পরের বছরে ঢাকা জজকোর্টে আইন ব্যবসায় শুরু করেন। তার দুই বছর পর আইন ব্যবসা শুরু করেন হবিগঞ্জে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হবিগঞ্জ মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিলর।
১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রথম অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং পরে দেওয়ানি মামলা পরিচালনায় খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে অ্যাটর্নি নিযুক্ত হন এবং ১৯৫০ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে কাজ করেন।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ পদে থেকে জনদাবির সমর্থনে সোচ্চার ছিলেন। ইসলামী ইস্যুতে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনে ছিলেন আপোসহীন। ১৯৬৫ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৭২ সালের ১৬ আগস্টে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হন। ১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর বাংলাদেশের ২য় প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়ে ১৯৭৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি পেশাগত ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। বিচারপতি মরহুম জনাব সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন সাহেব অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, নিরহঙ্কার, ধর্মভীরু ও সহজ-সরল ছিলেন। তিনি ইংরেজি, উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকারের ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্ব অধিকারী।
কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের দেখলেই হৃদয়ে শ্রদ্ধার ভাব জাগ্রত হয়। ১৯৬০ সালে একজন তরুণ আইনজীবী হিসেবে ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেওয়ার পর বার লাইব্রেরিতে স্যুট-টাই পরা অ্যাডভোকেট-ব্যারিস্টারদের ভিড়ে একজন শেরওয়ানি-সালোয়ার পরিহিত শ্মশ্রুমণ্ডিত দীর্ঘদেহী স্মিতহাস্য, চোখে সুরমামাখা সুফি চেহারার এক ভদ্রলোক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।তিনি হাইকোর্টে Senior Government Pleader. নাম হলো সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন।তার ধর্মীয় আধ্যাত্মিক পারিবারিক বিরাট ঐতিহ্যের কথা। পিতা-মাতার সূত্রে তিনি হজরত আলী (রাঃ) ও হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) উভয়েরই ধারাবাহিকতার গৌরব বহন করতেন। বৈবাহিকসূত্রে তিনি মুসুরীখোলার প্রখ্যাত পীর শাহ আহসান উল্লাহর (রহ.) নাতজামাই ছিলেন এবং নারিন্দার শাহ সাহেব লেনে পীর সাহেবদের হুজরাকেন্দ্রিক আবাসনে বসবাস করতেন। উকিল বারে তার অন্যতম বন্ধু ছিলেন তখনকার খ্যাতনামা Civil Lawyer মরহুম এম এইচ খোন্দকার (কিছু দিন আগের অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীর পিতা।
ইংরেজিতে বলা হয় High moral ground (for Judges). যিনি সেই অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন তিনিই শুধু বিচারক পদবাচ্য, বাকিরা শুধুই সংখ্যা মাত্র। আজ Moral ground is recklessly at a discount. তাই ঘটনা দুটির উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭৭ সালে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্ট আলাদা করার বিধান করা হয়। দুই কোর্টের দুজন পৃথক প্রধান বিচারপতি। এ ব্যবস্থা কয়েক মাস বলবৎ ছিল। সৈয়দ সাহেব যখন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন হঠাৎ তার এক প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রসন্তান ইন্তেকাল করেন। জানালা দিয়ে দেখা গেল এক সদ্য পুত্রহারা এক পিতা ছেলের লাশ বাড়িতে রেখে ফুল বেঞ্চে বসে কেস শুনছেন। যেহেতু জোহরের নামাজের পর জানাজা হবে তাই সকালে এসে কোর্টে বসেছেন।তার কথা শুনে হতবাক। কী বলবেন, দায়িত্ববোধ? There he stood on a high moral ground. The hallmark of a great Judge.
দ্বিতীয় ঘটনাটি তার অবসরগ্রহণ সম্পর্কিত। নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রযোজ্য আইন সংশোধন করে (বয়স সম্পর্কিত) তাকে আগাম অবসর দেওয়া হয়। স্বভাবতই তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাকে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি। সেই ঘটনার দায়দায়িত্ব, ন্যায়-অন্যায় প্রসঙ্গ, সে এক অন্য ইতিহাস। তার আচরণ সর্বকালের বিচারকদের জন্য High bench mark হয়ে থাকবে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবসর গ্রহণের পর সরকারি বাড়িতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। বক্ষ্যমাণ আলোচনা শুধু বিচারক, বিশেষত উচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রসঙ্গে। বাস্তব কারণে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ছাড়া সম্ভব হয় না। তাই যুক্তিযুক্ত সময়ে সরকারি বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু মাসের পর মাস নানা অজুহাতে দখলটি বজায় রাখা সম্পূর্ণ অনৈতিক। দুঃখজনকভাবে দেখা গেছে এ অনৈতিক প্রবণতাই প্রবল। কোনো অন্যায় সুযোগ গ্রহণ যে কোনো সময় যে কোনো বিচারকের পক্ষে দুর্নীতিরই নামান্তর। এবার দেখা যাক সৈয়দ সাহেব সরকারি বাড়ি ছাড়ার ক্ষেত্রে কী নজির রেখে গেছেন। তার শেষ কর্মদিবসে তিনি কোর্ট থেকে সরকারি বাড়ি ফিরে আসেন এবং সেখানে আসরের নামাজ আদায় করেন। যেহেতু মুসলিম Calendar অনুযায়ী সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে পর দিন শুরু হয়ে যায়, তাই সৈয়দ সাহেব মাগরিবের নামাজ সরকারি বাড়িতে পড়া সমীচীন মনে করেননি। মাগরিবের আজানের আগেই জায়নামাজটি কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি ১৯ নম্বর হেয়ার রোডের ‘প্রধান বিচারপতির বাসভবন’ ত্যাগ করে চলে যান এবং নারিন্দার বাসায় গিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন।
উনারই আপন সুযোগ্য ভাতিজা জনাব সৈয়দ জে, আর, মোদাচ্ছির হোসেন সাহেব ছিলেন বাংলাদেশের ১৪ তম প্রধান বিচারপতি। তিনি ২০০৪ ইং হইতে ২০০৭ ইং অবধি পুরো তিন বছর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির গুরুদায়িত্ব পালন করেন।বিগত কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশের ২য় প্রধান বিচারপতি মরহুম জনাব সৈয়দ এ,বি মাহমুদ হোসেন সাহেবের আপন সুযোগ্য সন্তান জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন সাহেব সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। অল্পের জন্য বয়সজনিত কারনে অবসর গ্রহণের ফলে তিনিও প্রধান বিচারপতির সম্মান জনক আসনে বসতে পারেননি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা যে বিভিন্ন সময়ে একই পরিবারের একাধিক সদস্য Supreme Court এর মতো সবচেয়ে উচ্চ বিচারালয়ে Top most লেভেলের বিচারকের দায়িত্ব অত্যন্ত সুনামের সাথে পালন করে ছিলেন।সিলেটের জন্য এবং সারা বাংলার জন্য সত্যিই এটা একটি অহংকার করার মতো বিষয়।
বিচারক হিসেবে মরহুম জনাব সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন সাহেব আইনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যখ্যাসহ অনেকগুলি সুস্পষ্ট রায় প্রদান করেন। যেমন, মাহবুব হোসেনের মামলায় তিনি রায় প্রদান করেন যে, সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কর্মচারীরা যেমন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে গণ্য নয় তেমনি এই দুই পক্ষকে প্রভূ-ভৃত্যের সাধারণ সম্পর্কেরও অন্তর্ভূক্ত করা যায় না। তবে তাদের চাকুরি সরকারি কর্মচারীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সংবিধিবদ্ধ পদ্ধতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাদের চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা যায় না।
মরহুম জনাব সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন সাহেব হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর (রঃ) এর ফার্সি ভাষায় লিখিত দিওয়ান-এ-গওসিয়া নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি ইংরেজি ও বাংলায় অনুবাদ করেন।
বাংলাদেশের এক অতি সম্মানিত প্রধান বিচারপতি ১৯৮২ সালের ২ রা আগস্ট দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরজগতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হন।উনি পরজগতের বাসিন্দা হলেও উনার অবিস্মরণীয় সৎ বিচারিক জীবন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। আল্লাহ্ রাববুল আলামিন তুমি তোমার এই সৎ ও সম্মানিত বান্দা সহ তামাম জাহানের পরলোকগত সকল মরহুম-মরহুমা দের বেহেশতের সবচেয়ে উচ্চ মাকামে পৌঁছাও।
আমিন।
Discussion about this post