এডভোকেট এ.এম জিয়া হাবীব আহ্সান
বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষা আদালত প্রতিষ্ঠার দাবী এখন জোরদার হচ্ছে। সম্প্রতি সুপ্রীম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিকুল হক সর্ব প্রথম এ দাবী উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে আমরা প্রতিদিন যুদ্ধ করছি কিন্তু কেউ একবারও বলেনা সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের মধ্যে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কোন কথা নেই। রাষ্ট্রীয় নীতিতে মানবাধিকার থাকলেও মৌলিক অধিকারের ভেতরে নেই।” মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দাবী করেন প্রবীণ এই আইনজীবী। তিনি আরো বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকর করতে হলে কমিশনের নিজস্ব আদালত থাকতে হবে। কমিশনের চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা একজন আপীল বিভাগের বিচারপতির সমান। তাহলে কমিশনের নিজস্ব আদালত থাকলে সমস্যা কিসে? কমিশনের আওতায় কোন আদালত না থাকায় কমিশন সরাসরি কোন তদন্তও করতে পারে না। পৃথিবীর অনেক দেশে মানবাধিকার কমিশনের নিজস্ব আদালত রয়েছে।’’
বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠাকল্পে ২০০৯ সনের ৫৩নং আইন অনুযায়ী একটি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে উক্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসর প্রাপ্ত সম্মানিত বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী। তিনি প্রাণান্তকর চেষ্ঠা চালিয়েও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা রোধ করতে পারেন নি। কেননা তার আদেশ দ্রুত কার্যকর হওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ এর ধারা ৬(১) এর বিধান অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেন। নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি নিজের অবস্থান সম্পর্কে একাধিকবার বলে ফেলেছেন, ‘‘ঢাল নাই, তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’’। সাত সদস্য বিশিষ্ট মানবাধিকার কমিশনের জনবল ও লজিষ্টিক সাপোর্ট বলতে তেমন কিছুই নেই।
কমিশনের চেয়ারম্যান সাহসের সাথে জোরালো বক্তব্য রাখলেও মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে তিনি এমন কোন যুগান্তকারী ঘটনা বা পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন এ পর্যন্ত এমন কোন নজির জাতির চোখে পড়েনি। তবে এ লোকটির আন্তরিকতার কোন অভাব নেই, তার অসহায়ত্বের এক করুণ দৃশ্য সম্প্রতি জাতির সামনে ফুটে উঠেছিল। তাহলো তিনি সিলেট জেলা কারাগারে কারাবন্দীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিজ চোখে অবলোকন করতে সেখানে সারপ্রাইজড্ ভিজিটে গিয়েছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সেখানে ঢুকতে দেয়নি। তাঁকে ঘন্টার পর ঘন্টা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির জন্য অপেক্ষার কথা বলে বসিয়ে রাখা হয় এবং অনুমতি না পাওয়ায় তাঁকে ফিরে আসতে হয়। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা না থাকায় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ও এ-ব্যাপারে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা জানি না। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মানবাধিকার সুরক্ষা আদালত রয়েছে। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে সংবাদপত্রে এ ধরণের ইউ.এন.বি পরিবেশিত একটি রিপোর্টে পড়েছি ‘গুন্ডা পাঠিয়ে পাওনা আদায়ের অপরাধে আই.সি.আই.সি.আই ব্যাংক’কে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল দিল্লীর ক্রেতা সুরক্ষা আদালত।’ এই রায় দিতে গিয়ে কনজিউমার কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি জে ডি কাপুর বলেন, “পাওনা আদায়ের জন্য এই ধরণের অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলি যেরকম পশুবৎ আচরণ করছে, তা সমাজে চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। ঋণের কিস্তি আদায়ে মাস্তান বাহিনী পাঠিয়ে বাড়ি বা দোকানের ওপর চড়াও হওয়া যায় না। মহল্লার লোকের সামনে কাউকে শাসানি দিয়ে অপমান করা যায় না। পাওনা মেলেনি বলে কারও ওপর নরপশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্দয় প্রহার করা যায় না, যারা এই ধরনের ধৃষ্ঠতা তথা দুঃসাহস দেখায়, তাদের কার্যকলাপ বরদাস্ত করা যায় না। ঋণের টাকায় কেনা গাড়ির চাবি বলপূর্বক ছিনিয়ে আনা যায় না। যে সমস্ত নরাধম বাহুবলীকে নিয়ে এই ধরনের বাহিনী গড়া হয়েছে, তারা সব খুনে ডাকাত।”
আইসিআইসিআই ব্যাংকের বিরুদ্ধে পশুবৎ আচরণের অভিযোগ এনে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তপন বসু নামে একজন। ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছিলেন তিনি। জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে তপন বসুর সেই গাড়িটিকে কব্জা করতে গিয়েছিল ব্যাংকের বাহুবলীরা। গাড়ীর চাবি ছিনিয়ে নিতে বন্ধুর ছেলেকে লোহার রড দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বত্র জখম করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে পাওনা আদায়ের এভাবে পশুবৎ গুন্ডাবাহিনী কেন পাঠানো হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিস ধরানো হয়েছে আইসিআইসিআইয়ের কালেকশন ম্যানেজার এবং পাওনা আদায়কারী বাহিনীর কর্তাকে।
এভাবে আমাদের দেশেও মানবাধিকার কমিশন যাতে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় দায়ী সরকারী, বেসরকারী শক্তিধর যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে সে জন্য একটি মানবাধিকার সুরক্ষা আদালত বা মানবাধিকার কমিশন আদালত প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নচেৎ শুধু বক্তৃতা বিবৃতি দেয়ার জন্য ‘ঠুঠো জগন্নাত’ তুল্য এ প্রতিষ্ঠানটির আদৌ কোন সুফল জনগণ পাবে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর ১১ ধারার বিধান মতে কমিশনকে শুধুমাত্র তদন্ত, সরকারের নিকট সুপারিশ, গবেষণা, পরামর্শ প্রদান, মানবাধিকার বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন, সচেতনতা সৃষ্টি, সুশীল সমাজ ও এন.জি.ও দের মানবাধিকার কর্মকান্ড ও তাদের প্রচেষ্ঠাকে সমন্বয় করা, মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা অনুসন্ধান পূর্বক মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংস্কারে সরকারকে পরামর্শ দেয়া, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মানবাধিকার প্রশিক্ষন এর ব্যবস্থা করা, মানবাধিকার উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যে কোন কার্য করা ইত্যাদি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
উক্ত আইনের কোথাও কমিশন চেয়ারম্যানকে সরাসরি, আইন প্রয়োগের কিংবা তাঁর নির্দেশ লংঘনের ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা নেই। সরকারী কোন বিভাগ তার সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলে কি হবে তারও কোন ব্যাখা মানবাধিকার কমিশন আইনে নেই। এ কারণেই সিলেট কারাগার পরিদর্শনে কমিশন চেয়ারম্যান এর মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিত্বকে বাঁধা প্রদানের দুঃসাহস দেখানো হয়। আমলাতান্ত্রিক এ সরকার ব্যবস্থায় উক্ত আইনে মানবাধিকার কমিশনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোন ক্ষমতা না থাকলেও উক্ত আইনে একথা উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে যে, [১২(২)গ ধারা] প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সরকারী কর্মচারী এবং সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের কর্মে নিযুক্ত কর্মচারীর চাকুরি সংক্রান্ত কোন বিষয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যাবলী ও দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত হবে না। এভাবে কৌশলে কমিশনকে শুধুমাত্র তদন্ত, সুপারিশ ও মধ্যস্থতার ক্ষমতার গন্ডীতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কতগুলো অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছিল, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লংঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’
মানবাধিকার কমিশনকে একটি পূর্ণাঙ্গ, কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর কোনো উদ্যোগ নেই, তখন সরকারের আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। সরকারের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু দেখা যায় মানবাধিকার কমিশন একটি লোক দেখানো প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলছে। কমিশনকে বিচারের ক্ষমতা প্রদান করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করতে হবে। বিধিমালা চূড়ান্ত করতে হবে, সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেশপ্রেমিক নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে, পর্যাপ্তসংখ্যক তদন্ত কর্মকর্তাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য লোকবল নিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে।
মানবাধিকারের প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের আন্তরিকতা মুখের কথায় নয়, কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হওয়ার বিষয়। এ প্রতিষ্ঠানকে ‘ঠুঁঠো জগন্নাথ’ এ পরিণত করা যেন না হয়। বিবেক ও চিন্তায় যারা পরাধীন, মতান্ধ তেমন ব্যক্তিদের এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে তা হবে মানবাধিকার ধ্বংসের জিন্দান খানা। মননে মগজে মানবাধিকার পন্থী বিবেকবান সৎ ও সাহসী ব্যক্তিত্বরাই পারেন এ মহৎ দায়িত্ব পালন করতে। বিশেষ করে মানবাধিকার সুরক্ষা আদালত বা মানবাধিকার কমিশন আদালত প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি সু-বিবেচনার দাবী রাখে। আসুন আমরা একটি নির্যাতন মুক্ত সুখী, সমৃদ্ধশালী মানবাধিকার বান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিষ্ট, সু-শাসন ও মানবাধিকার কর্মী।
Discussion about this post