মোঃমনিরুজ্জামানঃ-
স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। এটি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ অর্থাৎ বিজয় দিবস থেকে কার্যকর হয়।এতে ১৫৩ টি অনুচ্ছেদ, ১ টি প্রস্তাবনা এবং ৪ টি তফসিল আছে।এখন পর্যন্ত এটি সতেরো বার সংশোধন করা হয়।মুল সংবিধান ইংরেজিতে করা হয় এবং এটা বাংলায় অনুবাদ করা হয়। তবে বাংলা এবং ইংরেজির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যঃ-
১/ Written Constitution (লিখিত সংবিধান):
পৃথিবীতে দুই ধরনের সংবিধান আছে।(ক) লিখিত সংবিধান এবং (খ) অলিখিত সংবিধান। লিখিত সংবিধান বলতে বোঝায় সংবিধানের সকল মূলনীতি এবং অনুচ্ছেদ একটি বই আকারে লিখিত থাকবে।অন্য দিকে অলিখিত সংবিধান বলতে এমন না যে কোথাও লেখা থাকবে না বরং অলিখিত সংবিধান বলতে বোঝায় এই সংবিধানের মূলনীতি এবং অনুচ্ছেদগুলো কোন একটি নির্দিষ্ট বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে না বরং বিভিন্ন বইয়ে বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত থাকবে।বাংলাদেশ সংবিধান হলো লিখিত সংবিধান। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ কার্যকর হয়।এতে ১৫৩ টি অনুচ্ছেদ, ১ টি প্রস্তাবনা এবং ৪ টি তফসিল আছে।
২/ Rigid Constitution (অনমনীয় সংবিধান) :
Rigid Constitution বলতে বোঝায় যে সংবিধান সংশোধন করা কঠিন,যে সংবিধান সাধারণ আইনের মতো সংশোধন করা যায় না।এই ধরনের সংবিধান সংশোধন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন।বাংলাদেশের সংবিধান Rigid Constitution কারন সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের ক উপঅনুচ্ছেদের আ দফায় বলা আছে মোট সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পেলে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না।
৩/ Preamble (প্রস্তাবনা) :
বাংলাদেশের সংবিধান শুরু হয়েছে প্রস্তাবনা দিয়ে। সংবিধানের মুল কথা এবং মূলনীতি এই প্রস্তাবনা অংশে বিদ্যমান। সংবিধানের আইনগত এবং নৈতিক ভিত্তি হলো প্রস্তাবনা।এখানেই দেশের বৈশিষ্ট্য এবং উদ্দেশ্যের কথা বলা আছে।
৪/ Supremacy of the Constitution(সংবিধানের আধিপত্য) :
Supremacy of the Constitution বলতে বোঝায় সংবিধান হলো সকল আইনের উপরে।অন্য কোন আইন যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য হয় তাহলে ঐ আইন বাতিল হবে।Supremacy of the Constitution সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে।এখানে বলা আছে সংবিধান হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে যতখানি অসামঞ্জস্য ততখানি বাতিল হবে।
৫/ Unitary Government System(একক সরকার পদ্ধতি) :
Unitary system বলতে বোঝায় রাষ্ট্র হবে একক।সংবিধান অনুযায়ী সকল সরকারি ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এককভাবে থাকবে।বাংলাদেশ সংবিধান Unitary Government System কারন সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদে বলা আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হবে।
৬/ Unicameral Legislature(এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা) :
Unicameral Legislature বলতে বোঝায় দেশের আইনসভা হবে এককক্ষ বিশিষ্ট। বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে দেশের আইনসভা হবে এককক্ষ বিশিষ্ট এবং এর নাম হবে জাতীয় সংসদ।এই সংসদ দ্বারা তৈরিকৃত আইন বাংলাদেশের সকল জায়গায় প্রয়োগ হবে।
৭/ Fundamental Principles of State Policy(রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি):
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে।এখানে চারটি মূলনীতির কথা বলা আছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা।আইন বা অন্যকোন নীতি তৈরিতে এই মূলনীতি অনুসারে হবে।
৮/ Fundamental Rights (মৌলিক অধিকার) :
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মোট ১৮ টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে।যেমনঃ আইনের দৃষ্টিতে সমতা,আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, গ্রেফতার সম্পর্কে রক্ষাকবচ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি।এই সকল অধিকার উপভোগ করা নিশ্চিত করেছে সংবিধান। সুপ্রিমকোর্ট এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।কেউ যদি এই ভাগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে সে ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রীট আবেদন করতে পারবে এবং সুপ্রিমকোর্ট তা কার্যকর করবে।সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে কেউ এই ভাগের সাথে অসামঞ্জস্য কোন আইন তৈরি করতে পারবে না।যদি কেউ করে তাহলে যতটুকু অসামঞ্জস্য ততটুকু বাতিল হবে।
৯/ Independence of Judiciary (বিচার বিভাগের স্বাধীনতা):
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকের কথা বলা আছে বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২২ অনুচ্ছেদে।এখানে বলা আছে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ থেকে বিচারবিভাগের পৃথক রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।সংবিধানে বলা থাকলেও তা বাস্তবিকভাবে কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মাসদার হোসেন মামলার কার্যকর এর মাধ্যমে।
প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। অন্যান্য বিচারপতি এবং অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করেই নিয়োগ দেওয়া হয়।এই সম্পর্কে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে।
১০/ Ombudsman (ন্যায়পাল) :
Ombudsman বা ন্যায়পাল সম্পর্কে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে। এখানে বলা আছে সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পাল পদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারির কাজ সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতা সহ অন্যান্য ক্ষমতা দিতে পারে।তাকে যে ক্ষমতা গুলো দেওয়া হবে সে সেই অনুযায়ী কাজ করবে। ন্যায়পাল তার কাজ সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট তৈরি করবে এবং তা সংসদে উপস্থাপন করবে।কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ন্যায়পাল পদ প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই।তবে সরকারি বিভিন্ন কাজ তদারকি করার জন্য ন্যায়পাল প্রয়োজন।এটি একটি সাংবিধানিক পদ।
লেখকঃ
মোঃ মনিরুজ্জামান
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
Discussion about this post