খাইরুল ইসলামঃ
মোদের গরব, মোদের আশা- আ মরি বাংলা ভাষা;
তোমার কোলে তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা।
হ্যাঁ, এই মায়ের ভাষা বাংলাকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞায় তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। বাংলা ভাষাকে সমাসীন করার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ঘোষণার বদৌলতে আন্তর্জাতিক কাতারে সম মর্যাদায় উদযাপিত হচ্ছে মাতৃভাষা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক নজির। এসবই বাংলা ভাষার নিমিত্ত। কত কবি সাহিত্যিকের কল্পনা মাধুরীতে বাংলা ভাষা হয়েছে রাজকুমারী, তার ইয়ত্তা নেই। অর্থাৎ, মনের ভাবাবেগ প্রকাশে মধু মাখা বাংলার বিকল্প যেন নেই। অথচ, আইনের সূতিকাগার উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে বিপরীত চিত্র। বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনেকটাই অনাগ্রহ, দৈন্য, অরুচি পরিষ্কার ভাবে প্রস্ফুটিত সেখানে। ব্রিটিশ উপনিবেশের ফসল ইংরেজি যেন আইন সংশ্লিষ্টদের মনন দখল করে আছে। English belongs to elite class- যারা উচ্চ আদালতে চর্চা কিংবা বিচাররত, সমাজের একটি উঁচু নির্দিষ্ট পর্যায়ে নিজেদের জাহির করার পুচ্ছ প্রচেষ্টায় তাদের ব্যতিব্যস্ততা। বিশ্বায়নের যুগে শুধুমাত্র বাংলান্ধতা কিংবা বাংলা আঁকড়ে পড়ে থাকা সময় উপযোগী নয়, তা সচেতন মনা সবাই অবগত। তবে, শিকড় বা গোঁড়ারূপী বাংলা ত্যাগ করে ইংরেজির বিক্রম আধিপত্য সহ্য করাও দেশপ্রেমের পরিচায়ক হতে পারেনা। ইংরেজি ভাষা ত্যাগ করা নিরবুদ্ধিতা, কেননা আইন সহ প্রতিটি বিষয়ের ব্যাপৃতি বা বিশদ জ্ঞান ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থিত। আদালতপাড়ার বহুল পরিচিত শব্দ ‘নজীর’ (ইংরেজি- precedent) যাকে বলা হয় বিচারক প্রণীত পূর্ববর্তী কোন সিদ্ধান্ত বা রায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের এরূপ নজীর, আইনের ব্যাখ্যা, আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ ও বোধগম্যতা- সব কিছু পরিভ্রমণ করার মাধ্যম কিন্তু ইংরেজি। সুতরাং, উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষায় পূর্ণাঙ্গ প্রসিডিং বা আইনি প্রক্রিয়া মসৃণ ভাবে চলতে ইংরেজি ভাষার বিকল্প নেই- এ মত প্রতিষ্ঠার পেছনে শত জোরালো যুক্তি বিদ্যমান। কিন্তু, কখনো কি দেখা যায় বাংলা ভাষায় একটি আইনী প্রক্রিয়ার সূচনা থেকে রায় অবধি সম্পূর্ণ পথচলা? কিছু কিছু যশস্বী বিচারক কালেভদ্রে বাংলা ভাষায় রায় দিয়েছেন, ফলশ্রুতিতে সাহসের অন্য দৃষ্টি তারা ঠিকই কেড়েছেন। একবিংশ শতাব্দীর লগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষাকে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে অস্পৃশ্য করে দিলে ভাষার মানচিত্র থেকে বাংলা নামক তিলকটি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে ধীরে ধীরে। নিম্ন বা জেলা আদালত গুলোতে সাক্ষী জেরা থেকে শুরু করে শুনানি, তদন্ত রিপোর্ট পেশ, অনেকাংশে রায় প্রদান- সব মাতৃভাষার বদৌলতে হয়, যেটি আশাব্যাঞ্জক। আশ্চর্যের বিষয়, উচ্চ আদালতে এসে আশাহতের বেদনায় পুড়তে হয়। আইনজীবীদের স্ব-জাহির করার উপায়ই হোক, ইংরেজি রথে সওয়ার হয়ে আধুনিকতা বা স্মার্টনেস অর্জনই হোক আর বাংলায় পরিভাষা স্বল্পতা শীর্ষক অজুহাত উত্থাপনই হোক- ইংরেজি বৈ আইন চর্চা যেন শুদ্ধ হয় না!!
বাংলাদেশের সংবিধানে একটু নজর দেওয়া যাক। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে (১ম ভাগ) রয়েছে-
প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা (The state language shall be Bangla)
১৫৩ অনুচ্ছেদে (১১ ভাগ) রয়েছে-
সংবিধানের নির্ভরযোগ্য পাঠ বাংলায় হবে, ইংরেজিতে নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকবে। তবে বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। (There shall be an authentic text of this constitution in Bengali, and an authentic text of an authorized translation in English. Provided, in the event of conflict between Bengali & English, the Bengali one shall prevail)
পরিষ্কার, সংবিধানে বাংলাকে সমুন্নত রাখা হয়েছে। একই বোধ যদি উচ্চ আদালতে প্রতিফলিত হয়, ক্ষতি কী? অশিক্ষিত- অর্ধশিক্ষিত সাক্ষী, মামলার বাদী- বিবাদীর তুলনামূলক সুবিধার কথা চিন্তা করে বাংলা ভাষার যথেষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা আইনজ্ঞদের নৈতিক কর্তব্যে গিয়ে ঠেকেছে। পাশাপাশি রায় প্রদানের ক্ষেত্রে শুধু ইংরেজির প্রাবল্য উতরে যেন উভয় ভাষার সম ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত হয়। নচেৎ, বাদী- বিবাদী বা মামলা পক্ষযুক্তদের রায় অনুধাবনের জন্য এদিক সেদিক ছুটোছুটি অথবা শুধু রায় বোঝার জন্য আরও একজন আইনজীবী নিয়োগের রীতি স্থায়ীভাবে বদ্ধমূল হয়ে যাবে অচিরেই। বিচারকগণ বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার জন্য হলেও নিজ উদ্যোগে তথা নৈতিক কোণ থেকে ইংরেজিতে এবং অনুবাদ সমেত বাংলায় রায় দিতেই পারেন অবলীলায়। তাতে উচ্চ আদালতে বাংলা চলেনা- শীর্ষক যে কানাঘুষা, তা অনেকটাই প্রশমিত হবে। এতে করে বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত মর্যাদা সমুন্নত তো হবেই, উপরন্তু জনগণের বোধগম্যতার অধিকারও বিকশিত হবে। পাশাপাশি অবারিত হবে আইনি সহায়তা বা সেবার (Legal Aid) ক্ষেত্র।
Discussion about this post