আইনটি তৈরির প্রেক্ষাপটঃ
সংবিধানের সংশোধনীর কারণে আইনটি তৈরির পথ সুগম হয়ঃ
বিশেষ ক্ষমতা আইনটি মূলত একটি নিবর্তনমূলক আইন। কারণ, এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই অপরাধীকে সেটা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে গ্রেফতার করা হয়।
কিন্তু, তৎকালীন সময় মূল সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটকের কোনো বিধান ছিল না। পরবর্তীতে দেশে যখন বিশৃঙ্খল এবং অরাজক অবস্হা তৈরী হবার প্রবণতা বেড়ে যায় তখন ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩ প্রতিস্থাপন করা হয়। অনুচ্ছেদ ৩৩(৩) অনুযায়ী নিবর্তনমূলক আটকের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই আইনের অধীন গ্রেফতার করা হলে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি কিছু অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। যথাঃ
- (১)যথাসম্ভব শীঘ্রই গ্রেপ্তারের কারন জানার,
- (২)আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে আত্নপক্ষ সমর্থন করার,
- (৩)২৪ ঘন্টার মাঝে নিকটতম magistrate এর নিকট হাজির করা,
- (৪)২৪ ঘন্টার বেশি সময় আটক না রাখা।
সুতরাং, সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর ফলে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রনয়ণ করার পথ সুগম হয়েছে।
যেসব আইনের ধারাবাহিকতায় এই আইন
নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং বাংলাদেশ তফসিলী অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৫০) এর ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়। এবং উল্লেখিত তিনটি আইন রহিত হয়ে যায়।
বিশেষ ক্ষমতা আইন –
আইনটির ২(চ)নং ধারায় ‘ক্ষতিকর কার্য’ বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে’র এভাবে সংজ্ঞা দেয়া হয়:
- (ক) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা বিরোধী কার্যকলাপ;
- (খ) বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতিসাধন;
- (গ) দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা বা জননিরাপত্তা বিরোধী কাজ করা;
- (ঘ) দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী বা শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টি করা;
- (ঙ) দেশের আইন ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা প্রদান করা;
- (চ) জনসাধারণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা;
- (ছ) জনগণের মধ্যে অথবা জনগোষ্ঠীর কোনো অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা এবং
- (জ) দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা।
১৫ ধারায় ‘ধ্বংসাত্বক কার্য‘ বলতে বোঝানো হয়েছে কাজে দক্ষতা নষ্ট বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য কোনো কাজ করা অথবা নিম্নোক্ত সম্পদ বিনষ্ট করা:
- (ক) কোন সরকারি বা আধাসরকারি বা স্থানীয় সরকারের বা রাষ্ট্রায়ত্ব কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ইমারত, যানবাহন, যন্ত্রপাতি বা অপরাপর সম্পত্তি;
- (খ) কোন রেলপথ, রাস্তা, খাল, সেতু, বন্দর, জাহাজ মেরামতের কারখানা, বিমানবন্দর, টেলিগ্রাফ বা টেলিফোনের লাইন অথবা টেলিভিশন বা বেতার;
- (গ) রেলগাড়ি, জাহাজ বা উড়োজাহাজ;
- (ঘ) কোন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, বিতরণ বা সরবরাহে ব্যবহূত ভবন বা অন্যান্য সম্পত্তি বা কোন পয়ঃব্যবস্থা, খনি বা কারখানা; অথবা
- (ঙ) পাট, পাটজাত দ্রব্য, পাটের গুদাম, পাটকল, বা পাট বাঁধাই প্রেস;
কতিপয় শাস্তির বিধানঃ
১৫ ধারায় উল্লিখিত অন্তর্ঘাতমূলক কাজের জন্য মৃত্যুদন্ড/যাবজ্জীবন/১৪বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।।
- ১৯ নং ধারায় কোনো নাশকতামূলক সংঘসমূহ/ধ্বংসাত্মক সমিতি সমূহের কার্যক্রম যদি জনশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে সরকার তাদের সকল কার্যক্রম সর্বোচ্চ ৬মাসের জন্য স্থগিত করতে পারে। এবং উক্ত আদেশ ভঙ্গের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড/অর্থদণ্ড/উভয়দন্ডের বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
- ২১ধারার সরকার কর্তৃক ঘোষণাকৃত সংরক্ষিত স্থানসমূহ এবং ২২ধারার সংরক্ষিত এলাকায় জন্য নির্ধারিত আদেশসমূহ ভঙ্গ করলে এর শাস্তি হিসেবে ২৩ ধারায় ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।।
- জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ২৪নং ধারার অধীন কারপিউ জারীর করার ক্ষমতা দেয়া হয়, যে আদেশ ভঙ্গের জন্য ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
- ২৫তম ধারায় মজুতদারি/কালোবাজারির জন্য মৃত্যুদন্ড/যাবজ্জীবন/১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। ২৫(ক)তে কেউ নোট/কারেন্সী জাল, ২৫(খ)তে চোরাচালান এবং ২৫(গ)তে খাদ্য/পানীয়ে ভেজাল মিশ্রণ করার জন্যও একই পরিমাণ শাস্তির বিধান রয়েছে।।
- আর এসব ভেজাল খাদ্য/পানীয়/প্রসাধনী বিক্রয় করলে সর্বোচ্চ ৫বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।
উপদেষ্টা পর্ষদঃ
- বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীন আটককৃতদের গ্রেফতারের কারণ পর্যালোচনার জন্য সরকার ৯ ধারার অধীন তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন করবেন।
- সদস্যদের মধ্যে ২জন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন/আছেন/হওয়ার যোগ্য এমন হতে হবে, এবং এই দুজনের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান হবেন। বাকী ১জন প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সিনিয়র কর্মকর্তা থেকে আসবে।
- ১০ধারার অধীন সরকার কাউকে আটকের ১২০দিনের মধ্যে গ্রেফতারের কারণ সম্বলিত একটি রিপোর্ট উপদেষ্টা পর্ষদের নিকট প্রেরণ করবে। এবং ১১ধারার অধীন উপদেষ্টা পর্ষদ আটকের সর্বোচ্চ ১৭০ দিনের মধ্যে সরকারকে প্রতিবেদন পাঠাবে।
- আটকটি বাতিল না হলে, প্রতি ৬ মাসে তা একবার করে পর্ষদ কর্তৃক রিভিউ করতে হবে(ধারা১২)। তবে, সরকার চাইলে যেকোন সময় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে পারবে(ধারা১৩)।
বিচারঃ
এই আইনের অধীন অপরাধসমূহের বিচার করবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। আইনের শাসন সম্পর্কেও ক্ষেত্র বিশেষে ধারনা রাখা অতীব জরুরী বিষয়।
- তবে, সরাসরি ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা যায় না৷ ২৭ ধারায় বলা আছে, সাব-ইন্সপেক্টরের পদমর্যাদার নিচে নয় এমন কারো লিখিত অভিযোগ ব্যতীত অপরাধ আমলে নেয়া যাবে না।
- ২৮ধারানুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে দায়রা, অতিরিক্ত দায়রা এবং যুগ্ম দায়রা জজ নিয়ে।
- তবে সরকার যদি অতিরিক্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, সেক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট সেটার বিচারক হবেন।
- প্রত্যেকের এখতিয়ার ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত ক্ষমতানুযায়ী অনুরূপ হবে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনালের তফসিলে উল্লিখিত আরো কিছু আইনের অধীন সংগঠিত অপরাধের বিচার করতে পারবে৷ যেমনঃ- (1)Arms Act,1878 (2)Explosives Substances Act, 1908 (3)Emergency Powers Act, 1975 (4)Formalin Control Act, 2015
Discussion about this post