আকিব হাসান সাদঃ
বাংলাদেশে ছোট কিংবা বড় যেকোন ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে হলে তার জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হয়। অর্থাৎ অস্ত্র কেনার জন্য আগে লাইসেন্স করতে হয়।
The Arms Act of 1878 এবং The Arms Rules Act of 1924 এর আওতায় যে কোন সামরিক অথবা বেসামরিক নাগরিককে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়।আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে কিছু মানদণ্ড পূরণ করতে হয়।
- আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক হতে হবে।
- আবেদনকারীর জীবনের বাস্তব ঝুঁকি থাকলে, অর্থাৎ কেবলমাত্র আত্মরক্ষার ব্যাপার থাকলে তিনি আবেদন করতে পারবেন।
- ‘শর্ট ব্যারেল’ আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বয়স ন্যূনতম ৩০ বছর, ‘লং ব্যারেল’ আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২৫ বছর বয়স হতে হবে, এবং ৭০ বছরের নিচে বয়স হতে হবে।
- আবেদনকারীকে অবশ্যই আয়করদাতা হতে হবে। বছরে ন্যূনতম দুই লক্ষ টাকা আয়কর প্রদান করতে হবে।
- অনুমতি পেলে আবেদনকারী অস্ত্র আমদানি করেও আনতে পারবেন অথবা দেশীয় বৈধ কোন ডিলারের কাছ থেকেও অস্ত্র কিনতে পারবেন।
- একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য একজন নাগরিককে তার স্থায়ী ঠিকানা যে জেলার, সেখানকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লাইসেন্স ও আগ্নেয়াস্ত্র বিভাগ থেকে আবেদন পত্র সংগ্রহ করতে হবে।এক্ষেত্রে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবি শাখা তদন্ত করে আবেদনকারীর তথ্য মিলিয়ে দেখে একটি রিপোর্ট দিবে।এরপর জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনের পর সেটি পাঠানো হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনাপত্তি পত্র দিলে জেলা প্রশাসক ওই আবেদনকারীর বরাবরে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করবেন। এক্ষেত্রে আবেদনপত্রের সাথে বৈধ নাগরিকত্বের সনদপত্র, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি, ট্যাক্স সার্টিফিকেটের ফটোকপি, ছয় কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি, এবং লাইসেন্স ফি জমা দিতে হবে।
আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে সর্বশেষ ‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬’ আইনে কেবলমাত্র আত্মরক্ষার স্বার্থে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তবে, এই আইনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান সাধারণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক কখন ‘টেস্ট ফায়ার’ বা পরীক্ষামূলকভাবে ফাঁকা গুলি চালাতে পারবেন, সে সংক্রান্ত কিছু নিয়ম আছে।
নতুন কেনা অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক ‘টেস্ট ফায়ার’ করতে পারবেন।
এছাড়া যাদের পুরনো অস্ত্র বছর শেষে বার্ষিক নবায়ন করতে যাবেন, তখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ম অনুযায়ী ‘টেস্ট ফায়ার’ করা হয় অস্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণ করে দেখার জন্য।এছাড়া গুলি ক্রয় বা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও জেলা প্রশাসকের অনুমতি লাগে, এবং গুলির হিসাব সংশ্লিষ্ট থানা এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবহিত করতে হয়।গুলি সংগ্রহের বাৎসরিক সীমা বা পরিমাণ লাইসেন্সে নির্ধারিত থাকে।
এছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র যিনি ব্যবহার করবেন লাইসেন্সটি তার নামে থাকতে হবে, যেমন মালিক যদি ব্যবহার করেন তবে তার নামে লাইসেন্স থাকতে হবে।আবার কোন ক্ষেত্রে যদি আগ্নেয়াস্ত্রটি মালিকের দেহরক্ষী ব্যবহার করেন তাহলে বডিগার্ড এর নামে লাইসেন্স থাকতে হবে।এছাড়া কোন ব্যক্তি যখন নিজের অধিকারে আগ্নেয়াস্ত্র রাখেন, তখন সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়।
আগ্নেয়াস্ত্র হারিয়ে গেলে সাথে সাথে থানায় জিডি বা সাধারণ ডায়েরী করতে হবে।মালিক দেশের বাইরে গেলে, আগ্নেয়াস্ত্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট থানাকে জানিয়ে যেতে হবে যে কোনো নির্বাচনের আগে আগ্নেয়াস্ত্র স্থানীয় পুলিশের কাছে জমা দিতে হয়।এক বছর পর পর আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়।
অস্ত্র আইন নিয়ে কিছু কথা:
The Arms Act of 1878 এর আইনে অননুমোদিতভাবে অস্ত্র নির্মাণ, এর আংশিক পরিবর্তন ও বেচাকেনা, অস্ত্র আমদানি ও রপ্তানি, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বেআইনি কোনো অস্ত্র সরবরাহ এবং নিজের কাছে লাইসেন্সবিহীন আগ্নেয়াস্ত্র রাখা প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার কিংবা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে কাজকারবার করার জন্য লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থাও এ আইনে রাখা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে থানায় অথবা লাইসেন্সধারী সরবরাহকারির নিকট কোনো কোনো অস্ত্র জমা দেওয়ার কথাও বলা আছে।
এ আইন সরকারকে লাইসেন্স প্রদান, অস্ত্র নিয়ে চলাফেরার উপর বিধিনিষেধ আরোপ, লাইসেন্স বাতিল অথবা এর কার্যকারিতা স্থগিত করা সংক্রান্ত নিয়মকানুন তৈরি করার মত ক্ষমতাও প্রদান করেছে।উল্লিখিত বিধিনিষেধসমূহ ভঙ্গ করা এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এসব ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রাভেদে শাস্তির পরিমাণ হচ্ছে যাবজ্জীবন অথবা কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড। এছাড়া জ্ঞাতসারে লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয়, আইনত অস্ত্র রাখতে পারে না এমন ব্যক্তির নিকট অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং আলোচ্য আইনের অন্য যেকোন ধারা ভঙ্গ করাও এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধের মাত্রাভেদে এ ক্ষেত্রে শাস্তি হচ্ছে ছয় মাস পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই।
সবশেষে উল্লেখ্য যে, The Arms Act of 1878 এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন অস্ত্রশস্ত্র বলতে আগ্নেয়াস্ত্র, বেয়নেট, তরবারি, ছোরা, বর্শা, বর্শার ফলক, তীর-ধনুক বা অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম বোঝাবে। বিভিন্ন ধারায় সরকারি অনুমোদন ছাড়া অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার, প্রদর্শন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রায়ই দেখা যায়, বিভিন্ন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম তথা মারামারি, হাঙ্গামা ইত্যাদির সময় প্রভাবশালী অনেকেই অস্ত্র প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হয় না। এর মধ্যে এ আইনের 19 a ও 19f ধারায় সাধারণত অবৈধ অস্ত্র দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
অস্ত্র কারো জ্ঞানমতে, দখলে ও নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে বলে আইনে উল্লেখ থাকায় যার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার বা জব্দ হয় তাকে ছাড়া অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি দূর থেকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। কারণ ‘নিয়ন্ত্রণ’ উপাদানটি প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য। তাই 1878 সালের প্রণীত অস্ত্র আইনটি যুগোপযোগী করা এখন সময়ের দাবি৷
Discussion about this post