বিডি ল নিউজঃ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ অষ্টম দিনের মতো শুনানি করে বুধবার পরবর্তী দিন ঠিক করে।
বেঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাজাহান। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আদালত থেকে বেরিয়ে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ বক্তব্য শুরু করেছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রথম ও তৃতীয় অভিযোগের সমর্থনে বক্তব্য রাখা হয়েছে। বুধবার অন্যান্য চার্জে বক্তব্য রাখব।”
বুধবারই তার বক্তব্য শেষ হবে বলে আশা করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।
মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “মামলার বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্য পর্যালোচনা করে বলেছি ট্রাইব্যুনালে যেসব সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছে তাতে মুজাহিদকে সাজা দেওয়া দেওয়া যায় না। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের সময় সপ্তম অভিযোগটি ছিল না। এ বিষয়ের অভিযোগটি ট্রাইব্যুনাল আমলে নেয়নি।”
শুনানির বিষয়ে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রথম চার্জ ছিল সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে গায়েব করে দেওয়া।
“এ ব্যাপারে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, সিরাজুদ্দিন হোসেনের হত্যাকাণ্ডের জন্য খলিল নামের এক ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা হয়েছে। তাই একই অপরাধের জন্য আবার এই আসামিকে দণ্ড দেওয়া যায় না।”
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমি বলেছি, সেটি অপহরণ করার জন্য।”
তৎকালীন সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে মুজাহিদের বক্তব্যের ফলশ্রুতির প্রেক্ষাপটে তাকে শাস্তির দেওয়ার কথা আদালতকে বলেছেন বলে জানান তিনি।
“আর মুজাহিদকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এই অপহরণের আগে তৎকালীন সংগ্রামে একটি নিবন্ধ ছিল যেখানে সিরাজুদ্দিন হোসেন সমর্পকে কটূক্তি ছিল। … নভেম্বরের ২৪ তারিখে মুজাহিদ বক্তব্যে বলেন, যে প্রতিহত করতে হবে এবং বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে উনার যে হুমকি ছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে সিরাজুদ্দিন হোসেনের মতো অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের ধরে নেওয়া হয়েছিল ও হত্যা করা হয়েছিল।”
মাহবুবে আলম বলেন, “আমার বক্তব্য হলো, তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে অপহরণের জন্য। কিন্তু এর আগে ক্ষেত্র তৈরি করা এবং তাকে (সিরাজুদ্দিন হোসেন) তুলে নেওয়ার জন্য যে একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করা … এটা করেছিল তৎকালীন আল-বদর ও ছাত্র সংঘের নেতারা। মুজাহিদ যেহেতু ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন, এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব ছিল। ট্রাইব্যুনাল যদিও তাকে আলাদা শাস্তি দেয়নি, কিন্তু দোষী সাব্যস্ত করে সঠিক কাজই করেছে।”
অ্যার্টনি জেনারেল বলেন, মুজাহিদের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ ছিল- রণজিৎ নাথ নামক এক ব্যক্তিকে নিয়ে গিয়ে নানা রকম অত্যাচার করার।
“এখানে তাদের (আসামি পক্ষ) যুক্তি ছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার হুকুমটা দিয়েছিল আর্মি অফিসার এবং সেখানে মুজাহিদ ছিল। মুজাহিদ যদি থেকেও থাকে অত্যাচার তো করেনি।”
মাহবুবে আলম বলেন, “আমার বক্তব্য ছিল যে এই আর্মি অফিসার ও অন্যান্যরা যেখানে মুজাহিদও ছিলেন, সেই দল একটি আদেশ দিয়েছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ‘উসকো লে যাও’ এরকম একটি অর্ডার ছিল। সেই অর্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ও অত্যাচার করা হয়েছে।
“সুতরাং অত্যাচারটাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। ওই অর্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ও অত্যাচার করা হয়েছে। সুতরাং এতেও মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ের পরে।”
ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রায় ২১ মাস পর ২৯ এপ্রিল মুজাহিদের আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়। ২৫ মে শুনানি শেষে ওই দিনই আসামি পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে। মঙ্গলবার আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের পর রাষ্ট্রপক্ষ বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করে।
মুজাহিদের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, “সাক্ষী ও তথ্য পর্যালোচনা করে আমরা বলেছি, মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই মুজাহিদকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে খালাসের প্রার্থনা জানিয়েছি।”
এর আগে আপিল বিভাগ গত ১৫ এপ্রিল আপিলের ওপর শুনানির জন্য ২৮ এপ্রিল দিন ঠিক করে। তবে ওইদিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সাধারণ ছুটি থাকায় শুনানি হয়নি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সে বছর ১১ অগাস্ট আপিল করেন মুজাহিদ। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল না করলেও শুনানিতে অংশ নিয়ে দণ্ড বহাল রাখতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে বলে জানায়।
দুটি ট্রাইব্যুনালে সব মিলিয়ে ১৮টি মামলায় রায় হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মামলার ক্ষেত্রে আপিল হয়েছে।
এর মধ্যে তিনটি মামলায় আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় এসেছে; দণ্ড কার্যকর হয়েছে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের।
আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি।
আর শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
সব মিলে আটটি মামলায় আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
Discussion about this post