আইনের দৃষ্টিতে দেশের সব নাগরিকই সমান। প্রত্যেকেই ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকারী। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিককে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা অনেক সময় টাকা-পয়সার অভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারে না। এতে তারা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর তাই অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের সরকারী খরচে আইনী সহায়তা দিতে ২০০০ সালে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০’ নামে একটি আইন পাস করে সরকার। ২০০০ সালে এ আইনটি পাস হওয়ার পরে ২০০১ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। এ আইনের মাধ্যমে অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের সরকারী খরচে আইনী সহায়তা দিতে সংস্থার অধীনে ৬৪ জেলায় ‘জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি’ করা হয়।
এ কমিটি সরকারী খরচে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের মামলা পরিচালনা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনা ব্যক্তির মামলা করার প্রয়োজন হলে সরকারী খরচে মামলা দায়েরের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এ ছাড়া দেওয়ানি, ফৌজদারি, পারিবারিকসহ প্রায় ধরনের মামলায় আইনগত সহায়তা দেয় এই কমিটি। নারী, পুরুষ ও শিশু কেউ যদি টাকার অভাবে মামলা না করতে পারে অথবা বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকে, তাহলে সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা দেয়া হয় তাদের।
২০০১ সাল আইনটি কার্যকরের পর পরবর্তীতে সরকারের পরিবর্তন আসায় কার্যক্রম গতি না পাওয়া, বরাদ্দকৃত অর্থ অব্যয়িত থাকা, পৃথক অফিস না করাসহ অন্যান্য উদ্যোগ কম থাকায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত এর তেমন প্রচার ছিল না। ২০০৯ সাল থেকে আবার শুরু হয় আইনী সহায়তা দেয়ার কার্যক্রম। ১ ডিসেম্বর, ২০১১ তারিখে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) আইন, ২০১১ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০-এ পরিবর্তন এসেছে, যাতে জাতীয় পরিচালনা বোর্ড গঠনে সদস্যদের মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা পাবেন যারা
আইনগত সহায়তা প্রদানের আইন মতে, আর্থিকভাবে অসচ্ছল যে কোন ব্যক্তি (সুপ্রীমকোর্টের ক্ষেত্রে যার বার্ষিক গড় আয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার উর্ধে নয় ও অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে যার বার্ষিক গড় আয় ১ লাখ টাকার উর্ধে নয়), কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার উর্ধে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা, যে কোন শ্রমিক যার বার্ষিক গড় আয় ১ লাখ টাকার উর্ধে নয়, বয়স্কভাতা পাচ্ছেন এমন কোনা ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী বা শিশু, দুর্বৃত্ত দ্বারা এ্যাসিড দগ্ধ নারী বা শিশু, আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি, অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুস্থ নারীরা বিনামূল্যে আইনী সেবা পাবেন।
এছাড়া উপার্জনে অক্ষম এবং সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধী, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ ব্যক্তি, বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যক্তি এবং জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে সুপারিশ করা বা বিবেচিত কোন ব্যক্তি পাবেন এ সহায়তা।
আইনগত সহায়তার জন্য আবেদন কোথায়
সুপ্রীমকোর্টের পাশাপাশি প্রতিটি জেলা জজকোর্টে অবস্থিত ‘লিগ্যাল এইড অফিস’ (আইনগত সহায়তা অফিস), জেলখানা বা কারাগারের কর্মকর্তাদের কাছে, জেলা বা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয়, জেলা কমিটির সহায়ক কর্মকর্তা এবং অফিস সহকারীর কাছে; জেলা আদালতগুলোর বেঞ্চ সহকারীর কাছে; জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে এই সেবা পায়া যাবে।
যিনি দরখাস্তকারী তিনি নিজে বা তার মামলা তদারককারী বা তদ্বিরকারী লিগ্যাল এইড অফিসে সরাসরি আবেদন জমা দিতে বা দাখিল করতে পারেন। তা ছাড়া কারাগার কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন/ পৌরসভার চেয়ারম্যান বা মেয়র, কমিশনার, সমাজসেবা কর্মকর্তা বা বিভিন্ন এনজিওর কর্মকর্তার মাধ্যমেও আইনগত সহায়তার আবেদনপত্র লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠানো যায়।
আবেদনের নিয়মাবলি
আইনি সহায়তা পেতে হলে প্রথমে আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি তার নাম, পূর্ণ ঠিকানা এবং সহায়তা চাওয়ার কারণ উল্লেখ করে একটি সাদা কাগজে আবেদন বা দরখাস্ত করতে হবে ।
যে বিষয়ে আইনি সহায়তা চাওয়া হচ্ছে তা যদি হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারের বিষয় হয় তাহলে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার চেয়ারম্যান বরাবর এবং অন্যান্য আদালতের বিচারের বিষয় হলে জেলা কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করতে হবে।
এ ছাড়া কোনো জেলা কমিটি বরাবর সহায়তা পাওয়ার জন্য আবেদনপত্র বা দরখাস্ত দাখিল করা হলে সংস্থা বা জেলা কমিটি তাতে একটি নাম্বার দিয়ে আবেদনপত্রটির ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সংস্থা বা জেলা কমিটির পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবে।
আবেদনপত্রে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে যদি সংস্থা বা জেলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব না হয় তবে আবেদনকারীকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত তথ্য সরবরাহের জন্য পরামর্শ দিবেন।
এরপর সংস্থা বা জেলা কমিটির সভায় আবেদনপত্রটির আলোকে আইনগত সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা সংস্থা বা জেলা কমিটি কর্তৃক আবেদনকারীকে জানানো হবে। যদি কোনো আবেদনকারীর আবেদন জেলা কমিটি কর্তৃক নাকচ হয় তাহলে সেটা মঞ্জুরির জন্য ও আবেদনকারী তার আবেদন নাকচ হওয়ার তারিখ হতে ৬০ দিনের মধ্যে সংস্থার কাছে আপিল পেশ করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে সংস্থার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
সুপ্রীমকোর্ট কমিটি
শুধু ৬৪ জেলাতেই নয়, উচ্চ আদালতেও রয়েছে আইনগত সহায়তা সংস্থার অফিস। আনুষ্ঠানিকভাবে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর অফিসটির উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এর আগে গঠন করা হয়েছে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি।
বর্তমানে এ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। সঙ্গে রয়েছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীসহ আরও ১১ জন সদস্য। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ ১০ জন নিয়ে মূল লিগ্যাল এইড কমিটি। বাকি দু’জন পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন।
এ কমিটির মাধ্যমে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। ক্যাটাগরিগুলো হলো- ফৌজদারি আপীল ও রিভিশন, দেওয়ানি আপীল ও রিভিশন, জেল আপীল, রিট পিটিশন ও লিভ টু আপীল।
সুপ্রীমকোর্টে আইনী সেবা দেয়ার জন্য লিগ্যাল এইড অফিস হাইকোর্ট বিভাগে ৬৯ এবং আপীল বিভাগে ৫ আইনজীবী দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছেন।
দেশে বিচার ব্যবস্থায় অতীতে আইনগত সহায়তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের সব মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি বিচার পাওয়ার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে। চলতি বছরের গত ২৮ এপ্রিল দেশে চতুর্থবারের মতো ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’ পালিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় আইনগত সুবিধা প্রদান দিবসের’ অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী লিগ্যাল এইড কল সেন্টার জাতীয় হেল্পলাইনের উদ্বোধন করেন। এ হেল্পলাইনে ১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পাবেন দেশের স্বল্প আয়ের ও অসহায় বিচারপ্রার্থী নাগরিকরা।
২০০০ সালে প্রণীত আইনটি অনুযায়ী ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ গঠন করা হয়। রাজধানীর ১৪৫, নিউ বেইলী রোডে এ সংস্থার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এর ব্যাপ্তি সুপ্রিমকোর্ট, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেয়া হয়। জেলা কমিটি গঠন, প্রতিটি জেলা জজ আদালতে এর কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এতে দরিদ্র-অসচ্ছল ও অসহায় জনগণ বিচারপ্রাপ্তিতে সুবিধা পাচ্ছে। নানা প্রচার, প্রচরণা, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ সেবা বিষয়ে জনসচেতনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে (www.nlaso.gov.bd)। এ ওয়েবসাইটে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান বিষয়ে বিস্তারিত সব তথ্য জানা যায়।
এছাড়া হেল্পলাইনে (১৬৪৩০) ফোন করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা পাবেন স্বল্প আয়ের ও অসহায় বিচারপ্রার্থী নাগরিকেরা।
Discussion about this post