এ্যাডভোকেট পারভেজ তৌফিক জাহেদী
রাজশাহীর বিখ্যাত আইনজীবী মজিবর রহমান চৌধুরীর স্বরণে রাজশাহী বারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট পারভেজ তৌফিক জাহেদীর মন্তব্য।
যথেষ্ট পরিনত বয়সেই রাজশাহী তথা দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী জনাব মজিবর রহমান চৌধুরী আজ পরলোক গমন করলেন। কিন্তু তার পরেও মনে হয় বট বৃক্ষের মত তিনি তো আরো কিছু দিন আমাদের মাঝে থাকতে পারতেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী’র সকল আইনজীবীদের শিক্ষক , অভিভাবক ও আলোর বাতি ঘর।
স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় বা দেখা হয় সম্ভবত ১৯৯৫ ইং সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এল-এল.এম. এর মৌখিক পরীক্ষা’র রুমে যেখানে তিনি এক্সটার্নাল হিসাবে আমাদের ভাইভা নিয়েছিলেন।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কোন সাইডে প্র্যাকটিশ করবেন। যদিও আইন প্র্যাকটিশ বিষয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না। তবে সিনেমা বা নাটকে উকিল কর্তৃক সাক্ষীকে জেরা করে কুপোকাত করার দৃশ্য দেখার প্রভাবেই হয়তো আমি বেশি কিছু না ভেবেই বলে দিলাম ক্রিমিনাল সাইডে প্র্যাকটিশ করবো। উনি আস্তে করে হেসে দিয়ে বললেন খুব ভালো।
পরীক্ষার রুম থেকে বের হয়ে এসে আমার সহপাঠী বন্ধু বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের এডভোকেট এমদাদুল হাসানকে জিজ্ঞাসা করলাম উনি কে ? এমদাদের বাবা রাজশাহী এডভোকেট বারের আরেক খ্যাতনামা আইনজীবী মরহুম রফিকুল হাসান। সেই কারণে আমার বন্ধু জনাব চৌধুরীকে আগে থেকেই জানতো এবং আমাকে তার সম্পর্কে সবিস্তারে বললো। সেই থেকে উনাকে দেখা বা চেনা।
সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হলেও বিখ্যাত আইনজীবীদের এই ধরনের পরীক্ষায় আমন্ত্রণ জানানো হতো। মনে হয় একজন আইনজীবীর পড়াশোনা ও প্র্যাকটিশ লব্ধ জ্ঞান আইনের নতুন ছাত্রদের সাথে শেয়ার করার জন্য আহবান করা হতো যা অনেক ক্ষেত্রেই ওকালতির অভিজ্ঞতা না থাকা শিক্ষকগনের থাকে না। যাই হোক এইসব চল বোধ করি এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কারিকুলামে নাই।
আপনারা খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই তিনি এক্সাম রুমে আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করেছিলেন। হ্যাঁ সকল আইনজীবীকে তিনি আপনি বলে ডেকেছেন। একজন নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন। সাদা শার্ট, কালো টাই এবং কালো কোট ছাড়া কেউ তাকে কোনদিন দেখে নাই। কোন দিন কোন আইনজীবী বা মক্কেল কারো সাথে উঁচু স্বরে কথা বলেন নাই। আদালতে কখনো আবেগতাড়িত হন নাই। কোনদিন কোন কোর্টকে জোরে কথা বলেন নাই। এত সাবমিসিভ আইনজীবী আমি দেখি নাই। অসম্ভব রকম বিনয়ী। কোন রকম অহংকার ছিল না।
তবে নিজের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান অন্যজনকে অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। নিজেকে একটু আড়ালে রাখতেই বোধহয় পছন্দ করতেন।
আমি কোন কিছু না ভেবেই উনাকে বলেছিলাম ফৌজদারি সাইডে ওকালতি করবো। ওকালতি করবো সেটা নিয়েও সেই সময়ে আমি মোটেও সিরিয়াস ছিলাম না। কী অদ্ভুত ব্যাপার ! আমি এখন একজন উকিল এবং একান্ত ভাবেই ফৌজদারী উকিল।
আমি ব্যক্তিগত জীবনে বরাবরই একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপ। এটা অন্য কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি। আইন পাস হলো, বার কাউন্সিল সনদও হলো কিন্তু আদালতে যাওয়া বিষয়ে একটু অস্বস্তি বোধ করছি। কারন এর আগে শুধু মাত্র একদিন কোর্টে গিয়েছিলাম ইন্টিমেশন জমা দেওয়ার দিন। সেই প্রথম দিন আদালত প্রাঙ্গণের ভীড় , হৈচৈ , ধূলো বালি, ভ্যাপসা গরম ইত্যাদি দেখে একেবারেই হতাশ ছিলাম।
রাজশাহী বারের কাউকেও সেই ভাবে চিনিও না। উকিল বলতে তখন মাত্র দুই জন ব্যক্তিকে চিনি। বন্ধু এমদাদের বাবা এডভোকেট রফিকুল হাসান, রাজশাহী বারের তিন বারের সাধারণ সম্পাদক যার অধীনে কাগজে কলমে আমার জুনিয়রশীপ হয়েছিল এবং অন্যজন আমার মামা নাটোরের এডভোকেট রুহুল আমিন তালুকদার টগর, নাটোর জেলা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও নাটোর আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন সময়ের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি।
সবদিক বিবেচনায় আমি প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য নাটোরে মামা’র জুনিয়র হিসাবে কোর্টে যাওয়া আসা শুরু করলাম। প্রথমদিকে কিছুই বুঝি না।সব কিছু অচেনা লাগছে । ” পুট আপ ” দরখাস্ত কী ? ট্রান্সফার বেইল কী ? সিভিলের সত্যপাঠ কী ? কায়মোকাম কী ? মামার মোহরী বাবর আলী বাবুকে জিজ্ঞেস করি।
একই প্রশ্ন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উকিলদের কাছে জানতে চাই। এল-এল.এম পাস করে বার কাউন্সিল সনদ নিয়ে এসেও কিছু বুঝতেছি না। মনে মনে জেদ চেপে বসলো। এতদিন আমি কী পড়লাম। নতুন বিষয়গুলো বুঝতে বুঝতে ওকালতির জালে আটকে যেতে থাকলাম। প্রায় তিন চার মাস পরে আমি মনে করলাম এবার রাজশাহী যাওয়া দরকার।
ইতোমধ্যে রা.বি. আইন বিভাগের ক্লাসমেট বন্ধু মাসুদ হাসান চৌধুরী পরাগ বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের এডভোকেট ও সাবেক ডি.এ.জি. , বন্ধু এমদাদুল হাসান রুমা এবং আইন বিভাগের ক্লাসমেট বান্ধবী আজরা হোসেন সিমি বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ব্যাংকে কর্মরত রাজশাহী বারে নিয়মিত যাওয়া শুরু করে দিয়েছে।
সপ্তাহে শেষে শুক্র ও শনি বার রাজশাহীতে আড্ডা হয়। বয়সে সামান্য বড় কিন্তু পেশায় সমসাময়িক রাজশাহী বারের আইনজীবী নুরুল ইসলাম সরকার আসলাম ভাই ও বিশিষ্ট আইনজীবী জিল্লুর রহমান সাহেবের ছেলে মরহুম এডভোকেট জিয়াউর রহমানের সাথেও ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। সবাইকে বললাম রাজশাহীতে আমার একজন সিনিয়র এডভোকেট ঠিক করে দাও।
পরাগ ও আসলাম ভাই তাদের দুইজনের সিনিয়র রাজশাহী’র আরেকজন নামকরা আইনজীবী ও বারের তিন মেয়াদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাসার মোহাম্মদ সাইফুল আলম শেলী সাহেব কে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করলো আমার জন্য একটা সেরেস্তা ঠিক করে দিতে। জনাব শেলী রাজশাহীতে আরেকজন স্বনামধন্য আইনজীবী জনাব নজরুল ইসলাম খান এর কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন ও পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমার শ্রদ্ধেয় সিনিয়র নজরুল ইসলাম খান পুরোপুরি ফৌজদারী প্র্যাকটিশ করতেন। অন্য কোন মামলা করতেন না। কেন জানি খুব অল্প দিনের মধ্যেই পুরো সেরেস্তার দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে দিলেন। ওকালতি পেশা’র ফাঁদে ভালো ভাবেই আটকে যেতে থাকলাম। আমিও একান্ত ভাবেই ফৌজদারী সাইডে আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
আজ এতদিন পরে এসে মনে হচ্ছে আমাদের এই বরেণ্য আইনজীবী জনাব মজিবর রহমান চৌধুরীকে আমার বলা সেই কথা গুলো মহান সৃষ্টিকর্তা স্মরণে রেখেছিলেন। সেই কারণেই সম্ভবত আমি এখন ওকালতি পেশায় আছি এবং ফৌজদারী সাইডেই আছি !!
Discussion about this post