বিজিএমইএ ভবন ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের রায়ই বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে এখনো আশা ছাড়েনি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ’র নেতারা।
স্বপ্রণোদিত হয়ে জারি করা এক রুলের রায়ে ২০১১ সালের ০৩ এপ্রিল আইন লঙ্ঘন করে গড়ে ওঠা ১৮তলা বিজিএমইএ ভবনটিকে অবৈধ ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার নির্দেশনা দেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ । ভবনটি নির্মাণের আগে ওই স্থানের জমি যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় ফিরিয়ে এনে জনকল্যাণে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্প একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে তাদের টাকা ফেরত দিতেও বলেন হাইকোর্ট।
একই বছরের ৫ এপ্রিল বিজিএমইএ’র আবেদনে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। পরবর্তী সময়ে স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো বাড়ান সর্বোচ্চ আদালত।
এর দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্টের ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বিজিএমইএ।
গত বৃহস্পতিবার (০২ জুন) বিজিএমইএ’র আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টে এ মামলার অ্যামিকাস কিউরি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় ৯০ দিনের মধ্যে বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে হবে।
কিন্তু বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, আইনি লড়াইয়ের এখনও একটি ধাপ বাকি রয়েছে। সেটিরই ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ। আর তা হলো আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ আবেদন। ইতোমধ্যে বিজিএমইএ নেতারা সে সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর পরই রিভিউ আবেদন করবে বিজিএমইএ।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহ সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যা করা হবে তা আইন মেনেই করা হবে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আমরা রায়ের রিভিউ আবেদন করবো’।
অন্যদিকে ভবন ভাঙার সিদ্ধান্তটি সংগঠনের ইমেজ সঙ্কট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজিএমইএ’র সহ সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির। তিনি বলেন, ‘বিজিএমইএ একটি ব্র্যান্ড। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কথা এলেই বিজিএমইএ ভবনটির ইস্যু আসে। এখন বিজিএমইএ ভবনটি যদি ভেঙে ফেলা হয়, তাহলে তা ইমেজ সঙ্কট তৈরি করতে পারে’।
তিনিও বলেন, ‘রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর আমরা রিভিউ আবেদন জানাবো। আদালত যে রায় দেবেন আমরা তখন তা পালন করবো’।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। বিজিএমইএ বরাবরই যা করেছে, তা আইন মেনেই করেছে। বিজিএমইএ ভবন ভাঙার বিষয়ে এখনো বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষের কাছে আরও একটি ধাপ আছে। আইন মেনে রায়ের রিভিউ আবেদন করবে বিজিএমইএ’।
আদালত রায়ে বলেন, ‘বিজিএমইএ’র সদস্যরা দেশের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছেন, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকরাও তেমনি অবদান রাখছেন। যাদের শ্রমের জন্যই গার্মেন্টস কারখানা চলছে। হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালিরাও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখছেন। দরিদ্র কৃষকদের অবদানও কোনো অবস্থাতেই খাটো করার সুযোগ নেই। তাদের শ্রমের বিনিময়ে ফসল উৎপাদিত হচ্ছে বলে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বেচে যাচ্ছে। তাদের উৎপন্ন দ্রব্য না থাকলে বিজিএমইএ’র সদস্যসহ গোটা দেশের জনগণকে উপোষ থাকতে হতো’।
হাইকোর্ট বলেন, ‘সুতরাং আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে একটি শক্তিশালী মহলকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে এমন যুক্তি অগ্রহণযোগ্য। দেশের অন্য দশজনের মতো এই আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী লোকেরাও দেশের সাধারণ আইনের আওতাধীন। সংবিধান অনুযায়ী ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো বৈষম্য চলতে পারে না’।
আদালত বলেন, ‘বস্তুত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসাবে বিজিএমইএকে আইনের প্রতি আরও অধিক শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। অথচ তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ব্যবহার করেছেন’।
আদালত রায়ে বলেন, ‘ভবনটি সৌন্দর্য ও মহিমান্বিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এই ধংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট করা না হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রমিত করবে’।
‘সুতরাং সরকার এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ওপর নির্দেশ হলো, ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হবে। ওই জমি জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। হাতিরঝিল প্রকল্প একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প’।
আদালত বলেন, ‘বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে তাদের দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে। কারণ, তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল বেআইনি। কেননা, বিজিএমইএ’র ওই ভবন নির্মাণ বা ভবনের অংশ কারো কাছে বিক্রি করার কোনো অধিকার ছিল না। তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানতেন বা তাদের জানা উচিত ছিল যে, এই জমির ওপর বিজিএমইএ’র মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, সুতরাং আদালতের মতে, তারা কোনো সুদ পাওয়ার দাবিদার নন’।
সোনারগাঁও হোটেলের পাশে রেলওয়ের জন্য ১৯৬০ সালে সরকারের অধিগ্রহণ করা প্রায় ৬ দশমিক ২১ একর জমিটি ১৯৯৮ সালে কেবলমাত্র একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে দেয় রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো। ১৯৯৮ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণ শেষ হলে ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর ১৮তলার বিজিএমইএ ভবন উদ্বোধন করেন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এরপর থেকে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ভবনটি ব্যবহার করছে।
শুরু থেকেই রাজউক বলে আসছিলো, ভবনের নকশা সঠিকভাবে করা হয়নি। এ ভবনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও।
Discussion about this post