ফারহান তাম্বীরুল হক:
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুসারে টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ পান সাংসদরা। এই সুযোগের অপব্যবহার করে বিরোধী দল অবিরাম সংসদ বর্জনের রীতি তৈরি করেছে_ যা সংসদীয় গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম সংসদে বর্জনের হার ছিল ৩৪ শতাংশ, যা নবম সংসদে এসে ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা তাই আইন করে সংসদ বর্জনের কথা বলছেন। এ নিয়ে লিখেছেন ফারহান তাম্বীরুল হক সংসদীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদ। সংসদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য । প্রাণবন্ত আলোচনা ও যুক্তি-তর্কে প্রণীত হয় আইন। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আর সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে সংসদে কথা বলার চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো মাধ্যম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আর দ্বিতীয়টি নেই। সংসদকে কেন্দ্র করেই সুস্থ ধারার রাজনীতি বিকশিত হয়। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো একটি কার্যকর ও গতিশীল সংসদ। পার্লামেন্টের সদস্যদের ক্ষুরধার আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে উঠে আসে জনগণের নানাবিধ সমস্যা আর সেগুলো সমাধানের সম্ভাব্য পন্থাগুলো। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে থাকে পার্লামেন্টে। কিন্তু এ সব কিছুর কার্যকর অনুশীলনের জন্য প্রথমত প্রয়োজন সংসদের অধিবেশনে সব দল ও সদস্যের অংশগ্রহণ। ঠিক এই জায়গাটিতেই বাংলাদেশের সংসদ ও সংসদীয় রাজনীতি থমকে আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুদিন ধরেই সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। সংসদে সময় দেবার ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের আগ্রহ চোখে পড়ার মতো নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথা হলো বিরোধী দলে থাকাকালে সংসদ বর্জন করা আবার একই দল সরকারে গেলে বিরোধী দলের সংসদে অনুপস্থিতির ব্যাপারটি নিয়ে তুলকালাম করা। সংসদবিমুখ বিরোধী দল সংসদীয় বিতর্কে অংশগ্রহণ না করে বরং রাজপথে কর্মসূচি দেবার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ও পারঙ্গম থাকে। আগেই বলা হয়েছে যে, কোনো রাজনৈতিক দল সরকারি দলে যাওয়ার সুযোগ পেলে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন নিয়ে রাজনীতি শুরু করে এবং সংসদে ও সংসদের বাইরে গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে তীব্র নিন্দা ও গালমন্দ জানানো হয় এবং বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানানো হয়। বিরোধী দল থেকে বলা হয় সংসদে যাওয়ার পরিবেশ নেই। মজার ব্যাপার হলো, দীর্ঘ সময় অনুপস্থিতির কারণে সদস্যপদ যখন যায়-যায় অবস্থা, তখন পদ রক্ষার জন্য দু’এক মিনিটের জন্য সংসদে গিয়ে থাকেন সাংসদরা। বিরোধীদলহীন নিরুত্তাপ সংসদে নেতা-নেত্রীর বন্দনায় মুখর হয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন সরকারি দলের সদস্যরা। এভাবেই চলছে আমাদের সংসদীয় কার্যক্রম । প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সংসদকে কার্যকর ও সব কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু আদতে তা বাস্তবায়িত হয় না। নিজ এলাকার জনগণের জন্য কথা বলার জন্যই সংসদ-সদস্য নির্বাচন করেন সাধারণ মানুষ। অথচ নির্বাচিত হওয়ার পর বিরোধী দলের তরফ থেকে শুরু হয় সংসদ বর্জনের পালা। সংসদ অধিবেশনে অংশ না নিলেও প্রতি মাসে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি ঠিকই গ্রহণ করেন সাংসদরা। এমনকি স্থায়ী কমিটির সভাগুলোতে নিয়মিত যোগ দিলেও অধিবেশন কক্ষে যান না অনেক সংসদ সদস্য। বলা বাহুল্য, সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি বাড়ানোর পরও সংসদ অধিবেশনে উপস্থিতির হার অত্যন্ত হতাশাজনক। একারণেই এখন দাবি উঠেছে আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করার। সংবিধানের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিতির সুযোগ থাকায় বিরোধী দল অবিরাম সংসদ বর্জন করছে। পঞ্চম সংসদে বর্জনের হার ছিল ৩৪ শতাংশ, যা নবম সংসদে এসে ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সমপ্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করার সুপারিশ করেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস’ উদযাপনের অংশ হিসেবে টিআইবি ‘সংসদীয় উন্মুক্ততার ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ উপলক্ষে এ প্রস্তাব দেয়। টিআইবির সুপারিশে বলা হয়েছে, সংসদ কার্যকর ও গণমুখী করা এবং সংসদের মালিকানায় জনগণের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিদ্যমান আইন ও চর্চাকে ঘোষণাপত্রের আলোকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে। জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য সংসদের কার্যবিবরণী এবং সাংসদদের আয় ও সম্পদের বিবরণী নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করা, আইন প্রণয়ন ও সংসদীয় কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করে তা সহজলভ্য করার কথাও সুপারিশে বলা হয়েছে। প্রস্তাব তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের মতো সংসদ বর্জনের দৃষ্টান্ত বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করা এবং দলগতভাবে সংসদের অধিবেশনে যোগদান থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন বিরত থাকার প্রস্তাব করেছে টিআইবি, যার মধ্যে একাধারে সাতদিনের বেশি অনুপস্থিত থাকা যাবে না- এরূপ বিধান প্রবর্তনের প্রস্তাবও রয়েছে। এছাড়াও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধিকে আইনে রূপান্তরের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে সংসদকে কার্যকর করার স্বার্থে আইন করে সংসদ-বর্জন বন্ধ করার সময় এসেছে।
লেখক: স্টুডেন্ট, আইনবিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post