সম্পত্তি বেদখল কি?
অবৈধ দখলদার, প্রভাবশালী নেতা বা ব্যক্তির দ্বারা সম্পত্তি বেদখল হওয়া এখন সাধারণ একটা ব্যাপার। আর ভুক্তভোগী তখন নিরুপায় হয়ে হয় চুপ হয়ে যান নতুবা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু এই ধরনের কোন হুমকি বা সমস্যার সম্মুখীন হলে আপনিও আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
সাধারণত, সম্পত্তি বেদখল বলতে বোঝায় প্রকৃত মালিক বা দখলদারকে তার মালিকানা বা দখল থেকে জোর করে উচ্ছেদ করে অবৈধভাবে সেখানে অন্য ব্যক্তির স্বত্ব বা দখল প্রতিষ্ঠিত করা। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই প্রকৃত মালিককে জোরপূর্বক তার জমি থেকে উচ্ছেদ করে কিংবা চাতুরির আশ্রয় নিয়ে অন্যকে জমি থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। সম্পত্তি বেদখলে আপনার করনীয় হিসেবে অনেকেই জানেন না বেদখল হলে তার করণীয় কী?
ব্যক্তি কর্তৃক স্থাবর সম্পত্তি হতে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্বারের জন্য আপনার করণীয় বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
জমি বেদখলে আপনার করনীয় –
জমি থেকে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য দুই রকমের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
প্রথমত –
- স্থানীয়ভাবে সালিশের মাধ্যমে বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
- যেসব অঞ্চলে সালিশি প্রথা বিজ্ঞজনদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং যেখানকার অধিবাসীরা শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবোধসম্পন্ন, তারা এই উপায়ে এরকম বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে থাকে।
- স্থানীয় বিজ্ঞজনেরা সালিশে বসে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যদিয়ে জমির আসল মালিককে তার জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পারেন।
দ্বিতীয়ত-
- জমি থেকে বেদখল হলে প্রতিকার পাওয়ার আরেকটি উপায় আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চালানো।
- ফৌজদারি ও দেওয়ানি এই দুই প্রকার আইনেই জমি বেদখল হওয়ার বেশকিছু প্রতিকার পাওয়া যায়।

গ্রাম্য আদালতে মামলা কিংবা স্থানীয় সালিশ বিচার আশ্রয়ঃ
- আপনি এ ব্যাপারে প্রথমে গ্রাম্য আদালতে অভিযোগ করবেন কিংবা এলাকার মাতব্বর/বিজ্ঞজনদের জানিয়ে তাদের আপনার জমির বৈধ কাগজ দেখিয়ে দখল ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান করতে পারেন।
- এক্ষেত্রে গ্রাম্য আদালত কিংবা মাতব্বর/বিজ্ঞজনদের আপনাকে এবং অবৈধ দখলদারকে ডেকে বৈঠকের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন।
- তবে অনেক ক্ষেত্রেই যে অবৈধ দখল নেয়, তার প্রভাবের কাছে স্থানীয় বিচার টিকে না, এক্ষেত্রে যদি বৈঠকের সিদ্ধান্ত আপনার পক্ষে না যায় তবে হতাশ হবেন না।
- আপনার ওপর কেউ কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। বৈঠকের সিদ্ধান্ত আপনি যদি না মানেন তবে তাদের পরিষ্কার করে বলে দেবেন যে আমি আপনাদের সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারছি না ফলে আমি আইনের শরণাপন্ন হব।
- আইন ও আদালত আপনার জমি ফিরে পেতে আপনাকে যথেষ্ট সহায়তা দিচ্ছে।
ফৌজদারি প্রতিকারঃ
- জমি দখলকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখা দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন।
- এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে হবে প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আর এ মামলা করতে হবে বেদখল হয়ে গেলে কিংবা বেদখল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে।
- কোনো মামলা করলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিপক্ষের ওপর সমন জারি করবেন। পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবেন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে সম্পত্তির দখলদার কে তা নির্ধারণ করবেন।
- প্রয়োজনে সরেজমিনে তদন্তের আদেশ দিতে পারেন পুলিশকে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকৃত দখলদার কে, সে বিষয়ে রায় দেবেন।
- (তবে ১৪৫ ধারায় প্রতিকার চাইতে গেলে এখানে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করা যাবে না। এর মাধ্যমে শুধু প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করার জন্য প্রতিকার চাওয়া যাবে।)
১৪৪ ধারায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপঃ
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে উৎপাত বা আশঙ্কিত বিপদের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ আদেশ জারির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
এই ধারা অনুসারে, যেসব ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মনে হয় যে, এই ধারার অধীনে অগ্রসর হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে এবং সমস্যার আশু নিবারণ বা দ্রুত প্রতিকার বাঞ্ছনীয়, সেসব ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তিকে ওই ম্যাজিস্ট্রেট কোনো নির্দিষ্ট কাজ করা থেকে বিরত থাকার অথবা কোনো নির্দিষ্ট সম্পত্তি তার দখলে কিংবা তার অধীনে নেয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন, যদি ওই ম্যাজিস্ট্রেট বিবেচনা করেন, তার নির্দেশের কারণে আইনসঙ্গতভাবে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তির প্রতি বাধা, বিরক্তি বা ক্ষতি অথবা বাধা, বিরক্তি বা ক্ষতির ঝুঁকি, অথবা মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার প্রতি বিপদ অথবা জনশান্তির বিরক্তি, দাঙ্গা বা মারামারি নিরোধের সম্ভাবনা আছে কিংবা তার এই নির্দেশ তা নিরোধে সহায়তা করবে।
দেওয়ানি প্রতিকারঃ
জমি বেদখল হওয়ার দুই মাসের মাঝে ফৌজদারি আদালতে মামলা করতে ব্যর্থ হন তবে সেক্ষেত্রে আপনার জন্য দেওয়ানি আদালতে মামলা করার পথ খোলা থাকবে। দেওয়ানি আইন অনুযায়ী, দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে হলে জমি বেদখল হওয়ার তারিখ হতে ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে মামলার রায় পেতে কিছুটা সময় লাগবে। সম্পত্তি বেদখলে আপনার করনীয় প্রসঙ্গে, দেওয়ানি আদালতে বেদখল হওয়া জমির জন্য মামলা করতে হলে আপনাকে আপনার জমির মূল্য হিসেবে দেওয়ানি আদালতের বিভিন্ন জজ আদালতে যেতে হবে।
যেমন-
- (১) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার সহকারী জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে।
- (২) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি দুই লাখ এক টাকা থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার সিনিয়র সহকারী জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে।
- (৩) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি চার লাখ এক টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার যুগ্ম জেলা জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে।
- (৪) বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি পাঁচ লাখ এক টাকা থেকে অসীম পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার জেলা জজ অথবা অতিরিক্ত জেলা জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে।
যদি আপনার জমি বেদখল হয়ে যাওয়ার দুই মাস বা ছয় মাসের মাঝেও মামলা করতে পারলেন না কোনো কারণে তখন কী করবেন?
এক্ষেত্রে আপনি আপনার জমির দখল হারানোর ছয় মাসের বেশি হলে এবং ১২ বছরের ভেতরে হলে মামলা করতে পারবেন ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮/৯ এবং ৪২ ধারা মোতাবেক এখতিয়ার ভুক্ত দেওয়ানী আদালতে।
- সুতরাং, বিষয়সমূহ জানা থাকলে নিজের এবং অন্য কারও বিপদে এগিয়ে যেতে পারবেন। বাদী যদি সম্পত্তিতে নিজের স্বত্ব (মালিকানা) প্রমাণে সমর্থ নাও হন কেবল বেদখল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দখলে ছিল প্রমাণ করতে পারেন তবেই তিনি তার পক্ষে ডিক্রি পেতে পারেন।
- সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা মতে প্রদত্ত ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বা রিভিউ করার কোন বিধান নেই। তবে মহামান্য হাইকোর্টে রিভিশন করা যাবে।
- কিন্তু সরকার কর্তৃক বেদখল হলে এ আইনে কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে না। আবার ৬ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে মামলা তামাদি দোষে বাতিল হবে।
- তবে তামাদি আইনে দখলচ্যুতির ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা করা যায়।
মালিকানা দাবি করবেন যেভাবেঃ
জমির মালিকানা বা স্বত্ব দাবির জন্য দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে হবে। সম্পত্তি বেদখলে আপনার করনীয় হিসেবে, জমি অবৈধভাবে দখলচ্যুত হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে পারেন।
এ আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী জমির মালিক নির্ধারিত পদ্ধতিতে জমিটি পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রতিকার চাইতে পারেন। তবে এ ধারা অনুযায়ী, দখলচ্যুত ব্যক্তিকে জমিতে তাঁর স্বত্ব বা মালিকানা আছে কিংবা মালিকানার দাবি রয়েছে, তার ঘোষণা চাইতে হবে।
- না হলে এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয় না। ৮ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মামলাকে সাধারণত স্বত্ব সাব্যস্ত খাস দখলের মামলা বলা হয়।
- সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে হলে মালিকানা প্রমাণের দরকার নেই। শুধু জমি থেকে দখলচ্যুত হয়েছেন—এটি প্রমাণ করলেই চলবে।
- ৯ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেদখল হন, তবে তিনি বা তাঁর মাধ্যমে দাবিদার কোনো ব্যক্তি মোকদ্দমার মাধ্যমে এর দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো—বাদী অর্থাৎ যিনি প্রতিকার দাবি করেছেন, তিনি জমিটি দখল করে আসছিলেন কি না; বিবাদী তাঁকে জোরপূর্বক বেদখল করেছেন কি না; বিবাদী বেআইনিভাবে জমিতে প্রবেশ করেছেন কি না।
তবে বাদীকে অবশ্যই বেদখল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। সম্পত্তি বেদখলে আপনার করনীয় অনুযায়ী, অন্যথায় এ ধারায় মামলা করার অধিকার হারাতে হবে তাঁকে। তবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধারায় প্রতিকার চাওয়া যাবে না।
কোথায় ও কীভাবে আইনের আশ্রয় নেবেনঃ

জমিজমার মালিকানা নিয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে।
- মামলার মূল্যমান চার লাখ টাকার কম হলে সহকারী জজ আদালতে এবং চার লাখের বেশি হলে অসীম এখতিয়ার পর্যন্ত যুগ্ম জেলা জজ আদালতে প্রতিকার চাইতে হবে।
- মামলা দায়ের করতে হবে আইনজীবীর মাধ্যমে। মালিকানাসহ দখলের প্রতিকার চাইলে জমির মূল্য বাবদ অ্যাড-ভ্যালোরেম (মূল্যানুপাতে) কোর্ট ফি দিতে হবে।
- ৯ ধারা অনুযায়ী শুধু দখলের জন্য প্রতিকার চাইলে সম্পত্তির মূল্য অনুসারে যে কোর্ট ফি তার অর্ধেক, অর্থাৎ অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফির অর্ধেক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হবে।
জমির মালিকানাসহ দখল কিংবা শুধু দখল চেয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে যদি বাদী মনে করেন, তাঁর জমিটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে।
Discussion about this post