অনলাইন ডেস্ক
সরকারি পাঁচ ব্যাংকে সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে উত্তর বিক্রির অভিযোগে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক দেলোয়ার হোসেন, পারভেজ মিয়া এবং প্রেসকর্মী রবিউল আউয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা।
আশুলিয়ার প্রেস থেকে কর্মী রবিউল প্রশ্ন নিয়ে দেলোয়ারকে দেন। দেলোয়ার সেই প্রশ্ন আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী পারভেজ মিয়া ও মোক্তারুজ্জামান রয়েলকে দিয়েছেন। এর বিনিময়ে এক লাখ টাকা করে পেয়েছেন দেলোয়ার ও রবিউল।
দেলোয়ার তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, নিখিল রঞ্জন ধর নামে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক শিক্ষকও প্রতিবার প্রেস থেকে দুই সেট প্রশ্ন ব্যাগে করে নিয়ে যেতেন। দেলোয়ারের দাবি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান নিখিল রঞ্জনের মাধ্যমেই অল্প টাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়োগ পরীক্ষার টেন্ডারগুলো পেয়েছে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন নিখিল রঞ্জন। তিন আসামির জবানবন্দিতে কাজী শরীফুল নামে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা এবং দেলোয়ারের ভগ্নিপতি মুবিন উদ্দিনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানায় ডিবির একাধিক সূত্র।
গত রাতে যোগাযোগ করা হলে নিখিল রঞ্জন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি শুধু সেখানে টেকনিক্যাল সাপের্ট দিতাম। প্রশ্ন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। সে (দেলোয়ার) যা বলছে, এটা ঠিক নয়। আমি বুয়েটের শিক্ষক, আমি কেন প্রশ্ন নিয়ে আসব?’ এক প্রশ্নে নিখিল বলেন, ‘ওরা টেকনিক্যাল সাপোর্ট চায়, আমি তখন যাই। সিট ও সেন্টার অ্যারেঞ্জমেন্টটা আমি করে দিই। প্রশ্নের সব কিছু উনারাই করেন।
ডিবির তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে অনেকের নামই পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাবে না।’
গত বুধবার রাতে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে দেলোয়ার ও রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী থেকে পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহস্পতিবার তিনজনই ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদেও অপরাধ স্বীকার করেছেন তিনজন। এ সময় তাঁরা ছয় বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত বলে জানান। গত ৬ নভেম্বর সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস করে উত্তর তৈরির কাজ কিভাবে হয়েছে তা বর্ণনা করেন তিনজন।
জবানবন্দিতে দেলোয়ারের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। দেলোয়ারও কয়েকবার নিখিলের ব্যাগে প্রশ্ন দিয়েছেন। তবে ব্যাগে প্রশ্ন নিয়ে নিখিল তা বিক্রি করেছেন কি না, সেটা নিশ্চিত করতে পারেননি দেলোয়ার।
জবানবন্দিতে দেলোয়ার বলেন, গত ৬ নভেম্বরের প্রশ্ন দেলোয়ার সংগ্রহ করেন আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আশুলিয়ার যে প্রেসে ছাপায় সেখানকার কর্মচারী রবিউল আউয়ালের কাছ থেকে। রবিউল এক সেট প্রশ্ন জামার মধ্যে লুকিয়ে প্রেস থেকে বাইরে নিয়ে আসেন।
দেলোয়ারকে আহছানউল্লার টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল এবং ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়া প্রশ্ন ফাঁসে যুক্ত করেন। কমপক্ষে চার-পাঁচটি পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও রিটেনের প্রশ্ন এনে দিয়েছেন। এক লাখ টাকা পেয়ে তিনি আবার ৫০ হাজার টাকা রবিউলকে দিয়েছেন। ভগ্নিপতি মুবিন ও আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী শরীফুলকে আগে প্রশ্ন দিলেও পাঁচ ব্যাংকের ঘটনায় তাঁরা ছিলেন না। এবার ছিলেন ব্যাংকার শামসুল হক শ্যামল।
ডিবির সূত্র জানায়, দেলোয়ার ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার কাজী শফিকুল ইসলামের অফিসে পিওন হিসেবে চাকরি করতেন। কয়েক মাস পর জানতে পারেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা ও পরীক্ষার টেন্ডার পায় আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু ট্রেজারার পরীক্ষা কমিটিতে থাকতেন, সেহেতু তাঁকে প্রশ্ন্ন ছাপার বিভিন্ন কাজে নেওয়া হতো। আশুলিয়ার আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস নামের ছাপাখানায় যেতেন দেলোয়ার। সেখানে সুযোগ বুঝে প্রশ্ন সরাতেন।
জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল জানান, তিনি আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের কাটিংম্যান। তাঁর হাতের আঙুলের আঁচিলের জন্য আহ?ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেলোয়ারের কাছে ওষুধ চেয়েছিলেন। দেলোয়ার তাঁকে ফোন করে কামারপাড়া নিয়ে রয়েল ও পারভেজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন পাঁচ ব্যাংকের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের প্রস্তাব দেন। রয়েল তখন পারভেজকে তাঁর ছোট ভাই পরিচয় করিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। পরে চুক্তিমতো ২ নভেম্বর প্রশ্ন ছাপা হলে রবিউল একটি সেট লুকিয়ে রাখেন। ৪ নভেম্বর বিকেলে নবীনগর স্মৃতিসৌধের পাশে রয়েল ও পারভেজের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন রবিউল।
৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) পদে নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় এক হাজার ৫১১ কর্মকর্তা নিয়োগের জালিয়াতির তথ্য পেয়ে পাঁচ ব্যাংকারসহ আটজনকে আগেই গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। পরীক্ষা বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্য আট আসামির মধ্যে তিনজনও আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
Discussion about this post