বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পদ্ধতি ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার পদ্ধতিতে লেখাপড়া হয়ে থাকে। তবে অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন সেমিস্টার পদ্ধতি শুরু করেছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষদে সেমিস্টার পদ্ধতি তো আরেক অনুষদে বার্ষিক ভিত্তিতে পরীক্ষা হয়। মোট কথা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এ বিষয়ে কোনো শৃংখলা ও একক পদ্ধতি নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে সেমিস্টার পদ্ধতিতে লেখাপড়া হলেও সমাজবিজ্ঞান ও কলা অনুষদে বার্ষিক ভিত্তিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যেসব অনুষদে বার্ষিক ভিত্তিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে কমবেশি রয়েছে। এর প্রধান কারণ সময়মতো ক্লাস ও পরীক্ষা না হওয়া এবং সময়মতো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে না পারা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কিছুটা অবহেলা থাকলেও শিক্ষকদের দায়ই বেশি। কারণ তাদের অনেকেই স্বাধীনতা ভোগে যতটা আগ্রহী, দায়িত্ব পালনে ততটা মনোযোগী নন। কোনো কোনো ব্যস্ত শিক্ষক অন্যত্র পাঠদানের কাজে সময় পেলেও সময়মতো মূল কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সংখ্যক ক্লাস নেন না। ১৯৭৩ সালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ শিক্ষকদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে; কিন্তু তাদের দায়িত্বশীল করতে পারেনি। তারা এ অধ্যাদেশের অপব্যবহার করছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় হারায়। কিছুসংখ্যক শিক্ষকের গাফিলতির কারণে সময়মতো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত না হওয়ায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিভাগের চেয়ারম্যানকে শিক্ষার্থীদের ঘেরাও করার সংবাদ মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ হল, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসের পরীক্ষার ফলাফল তৈরি না করা। এখানে পরীক্ষার ফলাফল তৈরির দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। আগে এমনটি ছিল না। এক সময় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিস কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ধরা পড়ায় এবং তদন্তে এ অফিসের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ একাধিক কর্মকর্তার ব্যাপক দুর্নীতি প্রমাণিত হয়ে আদালত কর্তৃক সাজা হওয়ায় শিক্ষকদের ফলাফল তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার দৃষ্টিতে এটা ছিল মন্দ দৃষ্টান্ত। উচিত ছিল সৎ ও দক্ষ লোক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসে নিয়োগ দিয়ে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা, যাতে তারা দুর্নীতি করতে না পারেন। তা না করে শিক্ষকদের এ দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারটি হয়েছে থানার ওসি সাহেব দুর্নীতি করে সাজা পাওয়ায় ডিসি সাহেব এসে থানার দায়িত্ব পালন করার মতো। এর ফলে শিক্ষকদের গবেষণাপ্রবণতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তও পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দেরি হওয়ার একটি কারণ। মনে রাখতে হবে, সব শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা এক রকম নয়। কেউ হয়তো ১০০ বা ১৫০টি খাতা দেখে ১৫ দিনের মধ্যে ফেরত দেন; আবার কারও ৫০টি খাতা দেখে তিন মাস দেরি করে ফেরত দেয়ারও দৃষ্টান্ত আছে। একটি বর্ষের পরীক্ষায় ৭টি পেপার থাকলে ওই ৭টি পেপারের ১৪ জন পরীক্ষকের একজনও যদি খাতা দিতে দেরি করেন, তাহলে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব হয়ে যায়। তা ছাড়া শিক্ষকদেরই যদি পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করতে হবে, তাহলে ৬৫ জন লোকবলসমৃদ্ধ একটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিস থাকার প্রয়োজন কি?
১৯৭৩ সালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ শিক্ষকদের প্রধানত দুটি দায়িত্ব পালনের কাজ দিয়েছে। এর একটি হল ক্লাস নেয়া বা শ্রেণীকক্ষে পড়ানো এবং অন্যটি হল গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ করা। অর্থাৎ শিক্ষকদের মূল কাজ হল জ্ঞান বিতরণ ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করা। এ অধ্যাদেশ তো শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করা বা তাদের গ্রেডশিট লেখার দায়িত্ব প্রদান করেনি। একদিকে শিক্ষকদের কাছ থেকে আশা করা হবে উন্নত মানের গবেষণা প্রকাশনা, অন্যদিকে তাদের দিয়ে করানো হবে টেবুলেশন সিট ও মার্কশিট তৈরির মতো কাজ। এমন নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য আÍঘাতী। ডিজিটাল যুগে দ্রুত পরীক্ষা পদ্ধতিকে অটোমেশনের আওতায় এনে এ কাজ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসকে দিয়ে করানো উচিত। তবে এসব অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করা জরুরি।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে পড়ান, খাতা দেখেন এবং নম্বর প্রদান করেন। ব্যস, তাদের কাজ শেষ এবং তারপর তারা তাদের পড়াশোনা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিস দুর্নীতি করেছে বলে তাদের আর বিশ্বাস করা যাবে না এবং সে কাজ শিক্ষকদের করতে হবে, এ যুক্তি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষকরা ক্লাস করবেন, গবেষণা করবেন, নাকি শিক্ষার্থীদের টেবুলেশন করবেন এবং গ্রেডশিট লিখবেন? শিক্ষকরা হলেন গবেষক। তারা থাকবেন জ্ঞান গবেষণায় লিপ্ত। পৃথিবীর আর কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মার্কশিট লেখেন বলে আমি শুনিনি। এটা শিক্ষকদের জন্য বেমানান কাজ। একদিকে জ্ঞান বিতরণ ও গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে বলে, অন্যদিকে শিক্ষককে দিয়ে কেরানির কাজ করাবেন, তা তো হতে পারে না। এটিও পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে দেরি হওয়ার জন্য দায়ী। এ কারণে দেখা যায়, কোনো কোনো বিভাগে পরীক্ষার ফলাফল দিতে ৬-৭-৮ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় সেশনজট। দীর্ঘ হয় শিক্ষার্থীদের ছাত্রজীবন।
এখানে জটের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। তবে শিক্ষকরা কীভাবে দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারেন, সে সম্পর্কে কয়েকটি কৌশল তুলে ধরব। এ কৌশলগুলো যদি অন্য শিক্ষকরা ব্যবহার করে উপকৃত হন, তাহলে এ প্রবন্ধের আলোচনা সার্থক হবে। আমি দুই বছরাধিককাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সব সহকর্মীর সহায়তা নিয়ে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ সময়কালে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, একেকটি পরীক্ষার ফল দিতে ৭-৮ মাস সময় লেগে যায়। বিভাগীয় সেলফ অ্যাসেসমেন্ট কমিটির কাজ করার সময় পরীক্ষার ফলাফল জরিপ করে দেখিয়েছি, ২০১৪-২০১৫ অ্যাকাডেমিক সেশনের ৫টি পরীক্ষার ফলাফল ৮ মাসের আগে দেয়া সম্ভব হয়নি। এর ফলে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বিরক্ত হয়েছেন। তখন থেকে আমরা চেষ্টা করে আসছি কীভাবে কম সময়ে পরীক্ষার ফলাফল দেয়া যায়। ২০১৫-২০১৬ সালের দ্বিতীয় বর্ষ সম্মান পরীক্ষা কমিটির সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে পরীক্ষা কমিটি মেম্বারদের সহায়তায় ৪ মাসে পরীক্ষার ফলাফল দিতে পেরেছি। উল্লেখ্য, সবার সহায়তা না পেলে এককভাবে শত চেষ্টা করেও দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল দেয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, একটি পরীক্ষা কমিটিতে একজন সভাপতি এবং দু’জন সদস্য থাকলেও সমগ্র পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৮-১৯ জন শিক্ষক সংশ্লিষ্ট থাকেন। তাদের সবার আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দেরি হয়ে যায়।
পরবর্তী বছরে ২০১৬-২০১৭ অ্যাকাডেমিক সেশনের প্রথম বর্ষ সম্মান পরীক্ষা কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়ে আরও কম সময়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের চেষ্টা করি। এ উদ্দেশে আমি কতগুলো কৌশল অবলম্বন করি। যেমন, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে ৮টি পেপারের ১৬ জন পরীক্ষকের জন্য একটি চিঠি তৈরি করি। এই চিঠিতে পরীক্ষকদের যৌক্তিক সময়ের মধ্যে পরীক্ষার খাতা দেখে দিতে বিনীতভাবে অনুরোধ করি। আরও বলি, আপনার এ সহযোগিতা জট কমানোর প্রচেষ্টায় অবদানমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। অফিসকে পরীক্ষকদের খাতা দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের সঙ্গে একটি করে চিঠির কপি দিতে নির্দেশনা দেই। অফিসকে আরও অনুরোধ করি, একটি পরীক্ষা হওয়ার পর দেরি না করে দ্রুততার সঙ্গে যেন খাতাগুলো ডিকোডিং করে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষককে তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। কোনো শিক্ষক খাতা নিতে যেন গড়িমসি না করতে পারেন, সে জন্য তাদের কিছু নির্দেশনা প্রদান করি।
পরীক্ষা কমিটি পরীক্ষার ফলাফল তৈরি প্রক্রিয়ায় সব পরীক্ষকের নম্বর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সব পরীক্ষকের নম্বর এলে কমিটি তখন নম্বর ভাগাভাগি করে নিয়ে নম্বর গড় করে এবং তারপর তিনজন মিলে সে গড় মেলানোর পর টেবুলেশনের কাজ শুরু করেন। আমি এ ধারা ভেঙে ফেলি। পরীক্ষা কমিটির মেম্বারদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করি, আমরা সব নম্বর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব না। একটি পেপারেরও যদি দু’জন পরীক্ষকের নম্বর হাতে পাই, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটি তিনজনে ভাগ করে নিয়ে গড় করে ফেলব এবং পারলে গড় নম্বরও মিলিয়ে ফেলব। এর ফলে আমরা অনেক সময় বাঁচাতে পারি।
অনেক সময় টেবুলেশন ও গ্রেডশিটের কাগজপত্র প্রেস থেকে আসতে দেরি হওয়ার কারণে ফলাফল তৈরিতে দেরি হয়। এ ব্যাপারে প্রথমেই সতর্কতা অবলম্বন করি এবং প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা যথাসময়ের আগেই টেবুলেশন এবং গ্রেডশিটের কাগজপত্র হাতে পেয়ে টেবুলেরদের মধ্যে সেগুলো ভাগ করে দিই। এরপর ক্রমান্বয়ে সব নম্বর হাতে পেলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করি। টেবুলেশনের কাজ শেষ করে আমি এবং কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য মিলে ২-৩ দিনেই ২২৯টি গ্রেডশিট লিখে ফেলি। তারপর আমাদের অনুরোধে কমিটির আরেক সদস্য, যিনি নিজেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, মাত্র একদিনেই কষ্ট করে গ্রেডশিটগুলো যাচাই করে দিলে আমরা ওইদিনই সব টিম সদস্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসে গিয়ে পরীক্ষার ফলাফল জমা দিই এবং পরদিনই অফিস তা গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
এভাবে আমরা টিম স্পিরিট নিয়ে কাজ করে অতি দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে সক্ষম হই। আমরা মনে করি, শিক্ষকরা যদি আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারেন, তাহলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জটকে জাদুঘরে পাঠানো সম্ভব। আমরা স্বল্প সময়ে প্রথম বর্ষ বিএসএস সম্মান শ্রেণীর ফলাফল দিয়ে বিষয়টি প্রমাণে সক্ষম হই। স্মর্তব্য, এ বিভাগে ২০১৪-২০১৫ অ্যাকাডেমিক সেশনের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীর পরীক্ষার ফলাফল দিতে যেখানে সময় লেগেছিল ৮ মাস ৪ দিন; ২০১৫-২০১৬ অ্যাকাডেমিক সেশনের একই পরীক্ষায় সময় লেগেছিল ৯ মাস ৬ দিন, সেখানে ২০১৬-২০১৭ অ্যাকাডেমিক সেশনে একই বর্ষের ৭৫ জন ইমপ্র“ভমেন্ট পরীক্ষার্থীসহ মোট ২২৯ জন পরীক্ষার্থীর ফলাফল আমরা দিই ২ মাস ১৮ দিনে। এত দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে শিক্ষার্থীরা খুবই খুশি হয়। আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে টিম স্পিরিট নিয়ে কাজ করলে তাদের পক্ষে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জটকে জাদুঘরে পাঠানো সম্ভব।
-ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, akhtermy@gmail.com
-যুগান্তর থেকে সংগ্রহীত।
Discussion about this post