এডভোকেট মো: হাবিবুল হকঃ
বে-আইনীভাবে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য তল্লাসি ওয়ারেন্টের বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০০ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। এ ধারাটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ম্যাজিস্ট্রেটের যদি এরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে-যা রীতিরকম অপরাধের সামিল, তাহলে তিনি একটি তল্লাসি ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবেন। কাজেই আপনার স্ত্রীকে যদি শশুর বাড়ির লোকজন আটকে রাখেন তাহলে আপনি অনায়াসেই ফৌজদারী কার্যবিধির ১০০ ধারায় মামলা করে আপনার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পারেন।
তবে মনে রাখবেন আপনার স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় তার পিতা-মাতার সাথে বা অন্য কোন কারণে কারো সাথে থাকা অবস্থায় তাকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে আপনার আবেদনক্রমে তল্লাসী ওয়ারেন্ট ইস্যু করা সম্পূর্ণ বে-আইনী হবে। আর কারও স্ত্রী যদি আইনগত কোন কারণ ছাড়াই তার স্বামীর সাথে একত্রে বসবাস না করে, সে ক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। ১৭ ডিএল আর ৫৪৪ পৃষ্টায় এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে।
তবে দাম্পত্য অধিকার পুণরুদ্ধারের মামলায় বাদীকে অর্থাৎ স্বামীকে অবশ্যই প্রমান করতে হবে যে, সে নির্দোষ ও নিরীহ মনোভাব নিয়েই আদালতের কাছে বিচার প্রার্থী হয়েছে। স্ত্রী যদি প্রমাণ করতে পারে যে, স্বামী তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, তবে স্বামী ডিক্রি পাবে না। নিষ্ঠুরতার আকার প্রকৃতি এমন হতে হবে যে, ওই অবস্থায় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর ঘরে যাওয়া নিরাপদ নয়, এটাই স্ত্রীর পক্ষে বিরাট হাতিয়ারও বটে। পাশাপাশি স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর সাথে সংসার না করার আরেকটি হাতিয়ার হচ্ছে আশু দেনমোহর যতক্ষণ পর্যন্ত পরিশোধ করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করতে ও তাকে দাম্পত্য মিলনের সুযোগ দিতে অস্বীকার করতে পারে। কাজেই স্বামী দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে মামলা করলে সেই ক্ষেত্রে দেনমোহর অপরিশোধিত রয়েছে বললে স্ত্রীর পক্ষে উত্তম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
তবে মনে রাখতে হবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বৈধ বিবাহের অস্বিত্ব থাকতে হবে। আরেকটি জিনিস জেনে রাখার দরকার বিবাহের পূর্বে সম্পাদিত কোন চুক্তিতে যদি বলা হয় যে, বিবাহের পর স্ত্রী তার পিতা-মাতার সাথে বসবাস করতে পারবে, তাহলে এটি অবৈধ হবে। অনুরূপভাবে স্বামীর সাথেই সবসময় থাকতে হবে-এমন চুক্তিও গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়িতে বসবাস করার অনুমতি দান করে তাকে ভরণপোষণ প্রদানে সম্মত হয়ে তার সাথে সম্পাদিত চুক্তি আইন দ্বারা কার্যকর হবে। আর মনে রাখবেন স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এ মামলা চলে না। অনেক সময় দেখা যায়, স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এরকম হলে তা প্রমাণ করতে পারলে স্বামী এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আবার স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ আনেন, এ যুক্তি সত্য হলে দাম্পত্য অধিকার উদ্ধারে আদালত ডিক্রি জারি করতে পারেন। তবে স্বামী যদি সমাজচ্যুত কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান হন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিরুদ্ধে দাম্পত্য অধিকারের মোকদ্দমা অচল হবে এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরতে বাধ্য নন।
১৮ বিএলডি (১৯৯৮)-এ খোদেজা বেগম বনাম মোঃ সাদেক মামলার রায়ে বলা হয়, ‘দাম্পত্য অধিকার পূণরুদ্ধার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য একটি পারষ্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটি বৈষম্যমূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ হোসেন জাহান বনাম মোঃ সাজাহান মামলায় (১৮ বিএলডি, ১৯৯৮) বলা হয়, ‘বিনা কারণে যদি কোনো স্ত্রী দাম্পত্য মিলনে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামী মামলা করতে পারেন।’ স্ত্রী সংগত কারণ ছাড়া যদি স্বামীর সাথে বসবাস বন্ধ করে দেয় সেক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পূণরুদ্ধারের জন্য স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। (মুন্সী বজলুর রহিম বনাম সামসুন্নেসা বেগম, ১৮৬৭, ১১ এম.আই.এ. পৃষ্ঠা-৫৫১)। তবে মনে রাখতে হবে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে যে পক্ষ মামলাটি করে তাঁকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি স্বচ্ছ মনোভাব নিয়েই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং প্রমাণ করতে হবে যে, তাঁর জীবনসঙ্গী কোনো কারণ ছাড়াই ঘরে ফিরতে চান না।
এখন জেনে নিই দাম্পত্য অধিকার পূনরুদ্ধার মামলা করার নিয়মাবলী সম্পর্কে। মূলত ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ৫নং ধারার বিধান মতে, একজন ক্ষতিগ্রস্ত নারী পাঁচ বিষয়ে দেওয়ানী মামলা করার অধিকার প্রাপ্ত হন। তার মধ্যে পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারে মামলা আরজি দাখিলের মাধ্যমে করতে হয়। পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৬ মতে সাধারণত এ সব মামলার একটি আরজিতে যে বিষয় উল্লেখ থাকতে হয়। ১। যে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার নাম; ২। বাদীর নাম, বিবরণ ও বাসস্থানের ঠিকানা; ৩। বিবাদীর নাম, বিবরণ ও বাসস্থানের ঠিকানা; ৪। বাদী বা বিবাদী শিশু বা অসুস্থ-মনের অধিকারী হলে সেই বিষয়ের বিবৃতি; ৫। মামলা দায়ের করার কারণ এবং এই কারণ উদ্ভব হওয়ার স্থান ও তারিখ; ৬। আদালতের যে এখতিয়ার আছে তার বর্ণনা; ৭। বাদী যে প্রতিকার দাবি করেছে তার পরিষ্কার বিবরণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, উল্লেখিত সাতটি বিষয় বিস্তারিতভাবে আরজিতে উল্লেখ থাকতে হবে এ মামলায়।
মোঃ হাবিবুল হক
এডভোকেট
জজকোর্ট, ঢাকা।
মোবাইলঃ 01813613679
Discussion about this post