বিচারপতি টি.এইচ. খান বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণ আইনজীবী। তাঁর পুরো নাম তাফাজ্জল হোসেন খান। এ বছর এই বিদগ্ধ আইনজীবীর শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ তিনটি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভের গৌরব অর্জন করেছেন তিনি। সুদীর্ঘ ৭২ বছর (১৯৪৭-২০১৯) আইনপেশায় সম্পৃক্ত আছেন। আইনজীবীদের মধ্যে পূর্ববঙ্গে বিশেষত উচ্চ আদালতের বিচার ব্যবস্থার বিবর্তনের বয়োজ্যেষ্ঠ সাক্ষী হয়ে আছেন এই বিজ্ঞ আইনজীবী। বৈচিত্রময় জীবনযাপনের অপার সুযোগ লাভ করেছেন। আইনের বিস্তৃত পরিসরের বাইরে গিয়েও রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে সম্পৃক্ত আছেন। বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সুপ্রীম কোর্টের একজন প্রবীণ বটবৃক্ষ।
২০১৯ সালের ১২ জুন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর প্রকাশিত মনিটরিং দ্য সিটুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স অব বাংলাদেশ ( এমএসভিএসবি)- এর প্রতিবেদন অনুসারে,বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। এর মধ্যে পুরুষের আয়ু ৭০ দশমিক ৮ বছর। টি. এইচ. খান বাংলাদেশের একজন মানুষের গড় আয়ুর প্রায় সমপরিমাণ বিচার, যুক্তি ও বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ব্রিটেনে কোন নাগরিক ১০০ বছর আয়ু পেলে রাণী তাকে বিশেষ চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ করেন। বাঙ্গালিদের মধ্যে ইংল্যান্ডের রাণীর আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত নীরদ সি. চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯)। আইন পেশাজীবীদের মধ্যে জন অ্যাডামস ( ১৭৩৫-১৮২৬) ৯১ বছর, ওলিভার ওয়েন্ডেল হোলমস (১৮৪১-১৯৩৫) ৯৫ বছর, বিচারপতি আমিন আহমেদ (১৮৯৯-১৯৯১) ৯২ বছর, থুরগুড মার্শাল (১৯০৮-১৯৯৩) ৮৫ বছর ও ন্যালসন ম্যান্ডেলা ( ১৯১৮-২০১৩) ৯৫ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। এদিক থেকে টি. এইচ. খান এইসব গুণী ব্যক্তিত্বদের ছাড়িছে গেছেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন:
১৯২০ সালের ২১ অক্টোবর টি. এইচ. খান ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাধীন ঔটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভি আতর জামান খান। তিনি কৃষি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মা ফাজরুন্নেসা ছিলেন একজন গৃহিণী। টি. এইচ. খানরা তিন ভাই তিন বোন। ছোট ভাই তোজাম্মেল হোসেন খান এখনো বেঁচে আছেন। বর্তমানে তার বয়স ৯৫ বছর। উল্লেখ্য, টি. এইচ. খান পরিবারের সদস্যরা জন্মগতভাবে বেশি আয়ু লাভ করেন।
ময়মনসিংহের ফুলপুর হাইস্কুল থেকে টি. এইচ. খান মেট্রিকুলেশন (১৯৪০) পাশ করেন। সেকালে তাকে প্রায় ৯ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। পরে স্কুল-বোর্ডের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। সেখানে থাকাকালীন ম্যালেরিয়া রোগে আক্রন্ত হন। এসময় স্কুলে তিনি এক বছর পিছিয়ে যান। যোগাযোগ ব্যবস্থা অকল্পনীয়ভাবে নাজুক হওয়ার ২০ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। ১৯৪২ সালে আনন্দ মোহন কলেজ (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯০৮) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক এবং ১৯৪৬ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৯৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( ১৯৫২-১৯৫৪) দর্শন বিভাগ ও আইন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি জগন্নাথ কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন। ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পরীক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
পেশাজীবন:
১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর টি. এইচ. খান আইন পেশায় বি. কে. দের (বীরেন্দ্র কুমার দে) আর্টিক্যাল ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করেন। যদিও তিনি আইন ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৪৯ সালে। ১৪ মার্চ ১৯৫১ সালে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। পেশাজীবনে তার সিনিয়র ছিলেন বি.কে. দে। ১৯৬৭ সালের ২০ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধন লাভ করেন।
১৯৬৯ সালে টি. এইচ. খান সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন। ওই দিন সমরিক সরকার আইয়ুব খানের ( ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮-২৫ মার্চ ১৯৬৯) পতন ঘটে। তিনি হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল ( ১৯৬৫-১৯৬৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
ঢাকা হাইকোর্ট ও টি. এইচ. খান:
১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট বেঙ্গল হাইকোর্ট অর্ডারের মাধ্যমে ঢাকা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। টি. এইচ. খান হাইকোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নব প্রতিষ্ঠিত হাইকোর্টেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ. এস. এম আকরাম ( ১৮৮৮-১৯৬৮)। অন্যান্য বিচারপতিদের মধ্যে ছিলেন ই.সি.আরমন্ড (১৮৯৬-১৯৬২), টি.এইচ. এলিচ (১৮৯৪-১৯৮১), মোহম্মদ সাহাবুদ্দিন (১৮৯৫-১৯৭১), আমিন আহমেদ (১৮৯৯-১৯৯১) ও আমীরুদ্দিন আহমদ (১৮৯৫-)। উল্লেখ্য, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন (মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে নিয়োগ পান) এ ছাড়া সকলেই কলকাতা হাইকোর্টেও বিচারপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ঢাকা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠা এবং এর পরবর্তী প্রায় চার দশক টি. এইচ. খান পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বিশেষত উচ্চ আদালতের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৮ বছর আইনজীবী ( ১৯৫১-১৯৬৮), প্রায় ২ বছর বিচারপতি (১৯৬৯-১৯৭১) হিসেবে এবং ১৯৭৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে পুনরায় আইন পেশা চালিয়ে যান।
টি. এইচ. খান ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় সম্পৃক্ত থাকাকালীন বিখ্যাত আইনজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজ হলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মৌলভি তমিজউদ্দিন খান, এস. এর. পাল, বি. এন. চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুল হকসহ ( ঢাকা হাইকোর্টে বারের সেক্রেটারি, ১৯৬৮-১৯৬৯) প্রমুখ।
টি. এইচ. খান পরিচালিত কয়েকটি মামলার বিবরণ:
টি. এইচ. খান তার সুদীর্ঘ ৭২ বছরের পেশাজীবনে অসংখ্য মামলা পরিচালনা করেছেন। তবে, আইনজীবী হিসেবে ডিএলআর-এ ১৯৫১ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তার পরিচালিত রিপোর্টেড মামলার সংখ্যা হলো ১৩৩টি। তিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় ডিএলআর-এ তার প্রদত্ত রিপোর্টেড রায়ের সংখ্যা ৫৩ টি। ১৯৭৩ সালে পুনরায় আইনজীবী হিসেবে যোগদান করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার পরিচালিত ডিএলআর-এ রিপোর্টেড মামলাল সংখ্যা ১৫৬টি।
টি. এইচ. খান আইনজীবী হিসেবে পরিচালিত প্রথম রিপোর্টেড কেইসটি হলো স্বর্ণ কুমার রায় ও অন্যান্য বনাম সুকুমল চৌ. রায় ও অন্যান্য ৬ ডিএলআর ১৯৫৪, পৃষ্ঠা ৪৭৪। বিচারপতি হিসেবে রিপোর্টেড প্রথম রায়টি হলো ইদ্রিস আলী মাঝি বনাম রাষ্ট্র ২১ ডিএলআর ১৯৬৯, পৃষ্ঠা ৪৪৮। এই বেঞ্চে তার সঙ্গে সহ-বিচারপতি ছিলেন এস. ডি. আহমেদ ( রায় লেখক)। টি.এইচ. খান লিখিত প্রথম রিপোর্টেড রায়টি হলো হোশিয়ার আলী ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র ২১ ডিএলআর ১৯৬৯, পৃষ্ঠা ৫৭৫।
প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা:
টি. এইচ. খান আইন পেশার বাইরে রাজনীতি ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর আইন, শিক্ষা, ধর্ম, ভূমি ও রাজস্ব এবং ক্রীড়া মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাম্বিয়ার লুসাকায় অবস্থিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (সিপিইউ)- এ যোগ দেন। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নতুন সামরিক আইন জারি করা হলে টি. এইচ. খান আইন পেশায় পুনরায় ফিরে আসেন। ১৯৮৬ সালের এরশাদের নির্বাচনে বিরোধিতা করার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তিনি প্রায় পনের দিনের মতো হাজতে ছিলেন। টি. এইচ. খান দুই বার (০১৭৭-১৯৭৮ ও ১৯৭৫-১৯৯৬) বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯২ সালে টি. এইচ. খান সুইজারল্যান্ডের জেনেভার জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস কমিশনের সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৯১ সালের অক্টোবরে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে সাউথ এশিয়া জোন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তথা রুয়ান্ডা ট্রাইবুনালের বিচারপতি নির্বাচিত হন। তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল পদে বিচারকার্য পরিচালনারও দায়িত্ব পালন করেন।
টি.এইচ. খান ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সম্মানীয় কোষাধ্যক্ষ ( ১৯৭৭-১৯৮২) হিসেবে দায়িত্ব পলন করেছেন। তিনি উক্ত সোসাইটির আজীবন সদস্য। একই সময়ে তিনি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের কোষাধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রামণ করেছেন। ১৯৭৭ ও ১৯৯৭৮ সালে দুইবার টি. এইচ. খান পবিত্র হজব্রত পালন করেন।
পারিবারিক জীবন:
টি এইচ খানের স্ত্রী বেগম রওশন আরা জোবায়দা খানম। তিনি ২০১১ সালের ১৭ মে ৭৯ বছর বয়সে মারা যান। শ্বশুর মোহাম্মদ ইছাক উদ্দিন ছিলেন একজন জেলা জজ। টি. এইচ. খানের ছেলে সন্তান হলেন যথাক্রমে আফজাল এইচ খান, ফজলে এলাহী খান ও ফয়সাল এইচ. খান। জ্যেষ্ঠ ছেলে আফজাল এইচ. খান একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সাবেক সাংসদ। মেজো ছেলে ফজলে এলাহী খান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। সর্বকনিষ্ঠ অ্যাডভোকেট ফয়সাল এইচ. খান আইন পেশায় নিযুক্ত আছেন। একমাত্র মেয়ে ডা. মাহমুদা ফাতেমা খান ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক।
সংকলিতঃ স্মরণিকা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিবস ২০১৯।
Discussion about this post