প্রস্তাবিত ভূমি আইন, ২০২০ এর মাধ্যমে দেওয়ানি বিচারিক ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের করায়ত্তে নেয়ার অপচেষ্টা হওয়ায় তা সমূলে বাতিলের দাবী করে আইন কমিশন বরাবরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
আইন কমিশনে চিঠিতে বলা হয়, ”দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সাধারন মানুষের ন্যায় বিচারকে সুদূর পরাহত করবে। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, ক্ষমতার পৃথকিকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থি।”
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ.বি.এম খায়রুল হক মহোদয়ের বরাবরে পাঠানো পত্রে ঢাকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, “আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হল- সংসদ আইন প্রণয়ন করবে, বিচার বিভাগ সেই আইন দিয়ে বিচার করবে বা নাগরিকের সমস্যার সমাধান দিবে এবং নির্বাহী বিভাগ সেই আইন ও সমাধান বাস্তবায়ন করবে। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো সমস্যা বিদ্যমান থাকলে, বিরোধ থাকলে এবং কোনো বিষয়ে বিচারের প্রশ্ন জড়িত থাকলে সেই বিচার অবশ্যই বিচার বিভাগই করবে। কিন্তু বিচার বিভাগের এই বিচারিক ক্ষমতা এই আইনের মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয়েছে যা আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগকে আবারও পরাধীন করবে।”
অ্যাডভোকেট মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, “২৬৪ ধারায় ভূমি বিরোধ নিস্পত্তির জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হচ্ছে, এডিসি, এসি (ল্যান্ড) ও সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের সমন্বয়ে এই কমিটি ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি করবেন। বর্তমানে বলবৎ দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নির্বাহী বিভাগের করায়ত্তে হস্তান্তর করার কথা বলা রয়েছে, এতে বিচার বিভাগের উপর আবারও নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্ঠ হচ্ছে। এটি কোন ভূমি সংস্কার আইন নয় এটি প্রশাসনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি হাতিয়ার।”
“এ ধরনের আইন পাশ করার আগে সংসদকে ভাবতে হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাড়াবেন, নাকি বাদ দেবেন। আইন যদি করতে হয়, তবে ভূমি সংক্রান্ত সকল আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা দরকার, সেটা করাই যথার্থ হবে, নতুন আইন দরকার হবে না। কোন আইনজীবীই এই খসড়াটির পক্ষে মত প্রকাশ করেন নি। এই আইনটির মাধ্যমে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতাকে ভূলণ্ঠিত করে ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনার উপর প্রশাসনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে, যেমনি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের করায়ত্তে নেয়া হয়েছে, এই ড্রাফটের মাধ্যমে দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থাও প্রশাসনের করায়ত্তে নেয়ার ষড়যন্ত করা হচ্ছে। এই খসড়া সংক্রান্তে আইন কমিশন জনগনের মতামত চেয়েছে, আমাদের মতামত একটাই- এই খসড়টি অনতিবিলম্বে বাতিল করা হোক, করতেই হবে, পরিমার্জন বা সংশোধন করবার মত কোন কাঠামো এতে বিদ্যমান নাই।”
“বর্তমানে বলবৎ ২২টি ভূমি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনটিতে। যুগ যুগ ধরে এই আইনগুলো ভূমি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান দিয়ে আসছে। সময়ের পরিক্রমায় সমাজ ব্যবস্থা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে ঐ ২২ টি আইন তাদের উপযুক্ততা হারানোটা সাভাবিক। তাই বলে ঢালাও ভাবে সব বাতিল করে নির্বাহীবিভাগের করায়ত্তে নিতে হবে, এটা ঠিক নয়। যেখানে যেখানে সংশোধন করা দরকার সেই প্রয়োজনীয় সংশোধন করে আইনগুলোকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী করতে হবে। ঐ ২২টি আইন বাতিল করলে ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় বিরাট বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরী হবে, এতে কোন সন্দেহ নাই।”
“আজকের ভূমি ব্যবস্থাপনায় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা যুগ যুগ ধরে প্রশাসনের জটিলতা, ব্যর্থতা ও দৌরাত্মের ফলেই সেই বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সেই বিশৃঙ্খলা থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য মামলা। বাংলাদেশের ৭০-৮০ ভাগ মামলাই কোন না কোন ভূমি কে কেন্দ্র করে উদ্ভব। ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনের অদক্ষতা, জটিলতা, দৌরাত্ব ও ভুলের কারনে লক্ষ লক্ষ ভূমি সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে, আবার এইসব মামলার জের ধরে ফৌজদারি মামলাও বাড়ছে।”
“আদালতে ভূমিসংক্রান্ত মামলার যে জট তৈরী হয়েছে, সেই জট কমানোর জন্য নতুন উদ্ভাবনী কোন প্রস্তাব/সংস্কার/পদ্ধতি প্রণয়ন করতে পারত। সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে আমরা ভূমিসংক্রান্ত মামলা জটের কথা শুনে থাকি। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো সুপারিশ রাখতে পারত। তা না করে এমন একটি খসড়া তৈরী করল যা বাতিল করা ছাড়া সংশোধন করবার মত কোন কাঠামো এতে নেই।”
“এই খসড়াটি পাশ হলে ভূমি রেজিষ্ট্রেশন বা হস্তান্তর ব্যবস্থাতেও বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরী হবে। এ ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ, ডেভেলপারর্স, প্লট-ফ্ল্যাট ক্রেতা ও বিক্রেতা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”
“শুধু তাই নয়, ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সংক্রান্ত যে ব্যবস্থাপনার রয়েছে, সেসব ব্যবস্থাতেও একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। এছাড়াও প্রস্তাবিত আইনটি ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। মানুষের অধিকার ও সম্পদের সুষম বণ্টনের বিষয়গুলো প্রস্তাবিত আইনটিতে উপেক্ষিত হয়েছে।”
“বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর “মোবাইল কোর্ট’ এর নাম করে নির্বাহী বিভাগ ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে, এখন দেওয়ানি বিচারিক ক্ষমতাও করায়ত্ত করবার অপচেষ্টা চলছে। এই আইনি পাশ হলে দেওয়ানি আদালতের ৭০-৮০ ভাগ ক্ষমতা চলে যাবে নির্বাহী কর্তৃত্বে। এই খসড়া সংক্রান্তে আইন কমিশন জনগনের মতামত চেয়েছে, আমাদের মতামত একটাই- এই খসড়টি অনতিবিলম্বে বাতিল করা হোক, করতেই হবে, পরিমার্জন বা সংশোধন করবার মত কোন কাঠামো এতে বিদ্যমান নাই।”
মোঃ কামরুজ্জামান
অ্যাডভোকেট
জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।
Discussion about this post