অনলাইন ডেস্ক:
ঢাকা: ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরির পর তা আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে বসেই খামে ভরা হতো। ওই সুযোগে রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী দেলোয়ার হোসেন প্রশ্ন খামে ভরার সময় চুরি করতেন।
এরপর চুরি করা এ প্রশ্ন আইসিটি সেন্টারের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পারভেজ মিয়া ও টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েলকে দিতেন দেলোয়ার। এরপরই মোক্তারুজ্জামান প্রশ্ন পাঠিয়ে দিতেন ব্যাংকার সিন্ডিকেটের কাছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় একটি চক্রের গ্রেফতার হওয়া ছয় আসামিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে আসে।
এছাড়া শনিবার (১৩ নভেম্বর) প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্তে দায় স্বীকার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া দুই আসামি।
তারা হলেন- জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার (বরখাস্ত) সামশুল হক শ্যামল (৩৪) ও আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬)।
বোরবার (১৪ নভেম্বর) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, আসামি মোক্তারুজ্জামান রয়েল আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দিতে জানান, বিগত সময় চারটি নিয়োগ পরীক্ষায় দেলোয়ার ও পারভেজের সহায়তায় তিনি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়েছেন।
প্রশ্ন আকারে তাদের কাছে সেটি থাকলেও ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ চুক্তিতে আসা চাকরিপ্রার্থীদের তারা উত্তর তৈরি করে দিতেন। এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতেন চক্রে জড়িত ব্যাংকার সদস্যরা। আর এ সুযোগে ব্যাংকার সদস্যরা চাকরিপ্রার্থী ঠিক করতেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর ও গাবতলীতে চক্রের সদস্য জাহিদ, জানে আলম মিলন ও মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের তত্ত্বাবধানে গত ৬ নভেম্বরের ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে ৬০ জনকে উত্তর মুখস্থ করানো হয়।
মাতুয়াইলের একটি বাসার বুথে মমিন ও সামাদ ১০ জনকে উত্তর মুখস্থ করান। একইভাবে শাওন, হাকি, কাফি, রাজীব, লিটু, উজ্জল ও গোলাম রব্বানীর বাসার বুথে পরীক্ষার্থীদের উত্তর মুখস্থ করানো হয়।
এভাবে নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে কেন্দ্রের কাছে ১০টি বাসায় বুথ তৈরি করে ১০১ চাকরিপ্রার্থীকে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হয়। এছাড়া আরও শতাধিক প্রার্থীকে অনলাইনে উত্তর দেওয়া হয়। এর ফলে প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেন প্রশ্নপত্র খামে ভরার সময় চুরি করতেন। পরে তা রয়েল ও পারভেজকে দিতেন। রয়েল সেই প্রশ্ন দিতেন জনতা ব্যাংকের অফিসার সামশুল হক শ্যামল এবং রূপালী ব্যাংকের জানে আলম মিলনকে।
মিলন ও শ্যামলের মাধ্যমে প্রশ্ন চলে যেতো জনতা ব্যাংকের অফিসার এমদাদুল হক খোকন ও পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের কাছে। তাদের তত্ত্বাবধানে গ্রেফতার হওয়া আসামি রাইসুল ইসলাম স্বপন (৩৬), মাইনুল, আতিক, জাকির, হেলাল, টিটু, আজাদ ও শীতলের মাধ্যমে উত্তর আকারে চাকরিপ্রার্থীর কাছে যেতো।
পারভেজ মিয়া আলাদাভাবে প্রশ্ন দিতেন জাহাঙ্গীর জাহিদ, রবিউল ইসলাম এবং জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সোহেল রানার কাছে। তারা কবীর, প্রবীর, নবাব ও সুমনের কাছে প্রশ্ন দিতেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ১ হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ শূন্য পদের নিয়োগ পরীক্ষা গত ৬ নভেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংক ১৮৩টি, জনতা ব্যাংক ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংক ৫০০টি, রূপালী ব্যাংক ৫টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৭টি পদ রয়েছে।
বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।
গত ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ।
গোয়েন্দা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেড়িয়ে আসে, গ্রেফতার হওয়া সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়। এ পর্যন্ত চক্রটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁসের মাধ্যমে দুই শতাধিক চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
Discussion about this post