মোঃ মনিরুজ্জামান
আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে ” সরকারি চাকরি হলো সোনার হরিণ “।বাংলাদেশের যে অবস্থা, এখানে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সেই পরিমান চাকরির জায়গা এখানে নেই।তাই তো এখানে এতো বেশি শিক্ষার্থী বেকার বসে থাকে।এ দেশে একটা চাকুরির জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী চাতক পাখির মতো বসে আছে।আর সেখানে যদি সরকারি চাকরি হয় তাহলেতো সোনায় সোহাগা।আর এই সোনার হরিণ যদি হাতে পেয়েও হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে এর চেয়ে দূর্ভাগ্য আর নেই।যে কয়টা কারনে এই সোনার হরিণ নামক সরকারি চাকরি হাতছাড়া হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়া।
এখন চলুন আমরা যে সম্পর্কে জানতে চলেছি।
- কখন ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হলে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন আর কখন বরখাস্ত হবে না।
- কখন ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হলে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হবেন।
- কোন শিশু কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে সেও কি সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হবে?
- বরখাস্তকৃত কর্মচারি কি পরবর্তীতে আবারো নিয়োগ পাবে?
- নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কি কি দণ্ড দিতে পারে?
কখন ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হলে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন আর কখন বরখাস্ত হবে নাঃ
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়োগ ও তাদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২০১৮ সালে তৈরি করা হয় ” সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮”
এই আইনের ৪২ ধারার উপধারা ১ এ বলা আছে “কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক মৃত্যু দণ্ড বা ১ (এক) বৎসর মেয়াদের অধিক মেয়াদের কারাদন্ডে দণ্ডিত হইলে , উক্ত দণ্ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে চাকরি হইতে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হইবেন”
অর্থাৎ কোনো সরকারি চাকরিজীবী যদি কোনো ফৌজদারি মামলায় এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত দ্বারা ১ (এক) বৎসরের বেশি সময়ের জন্য দণ্ডিত হয় তাহলে যেইদিন এই শাস্তির রায় বা আদেশ প্রদান করবেন সেই দিন থেকে উক্ত ব্যাক্তি সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন।
তবে কেউ যদি ১ (এক) বৎসরের কম সময়ের জন্য দণ্ডিত হয় তাহলে কিন্তু সে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন না।সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪২ ধারার উপধারা ২ এ বলা আছে সরকারি চাকরিজীবী যদি ১ (এক) বৎসরের কম সময়ের জন্য দণ্ডিত হয় বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হয় তাহলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে কিছু দণ্ডের মধ্যে যে কোনো দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে।
যেমনঃ
(ক) তিরস্কার;
(খ) নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ;
(গ) নিম্ন পদ বা নিম্নতর বেতন স্কেলে অবনতিকরণ; অথবা
(ঘ) কোনো আইন বা সরকারি আদেশ অমান্যকরণ অথবা কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত অবহেলার
কারণে সরকারি অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতি সংঘটিত হইলে যথোপযুক্ত ক্ষতি পূরণ আদায়।
যেহেতু আইনে বলা আছে ১ (এক) বৎসর মেয়াদের অধিক মেয়াদের কারাদন্ডে দণ্ডিত হইলে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন সুতরাং যদি কেও সোজাসুজি ১ (এক) বছরের জন্য দণ্ডিত হয় তাহলে কিন্তু সে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন না।
বিঃদ্রঃ রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় সরকারি চাকরি হতে বরখাস্তকৃত ব্যাক্তিকে উক্ত বরখাস্ত থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কারন আছে তাহলে তিনি উক্ত বরখাস্তকৃত ব্যাক্তিকে বরখাস্ত থেকে অব্যাহতি দিতে পারবেন।এবং এরূপ আদেশ দিলে উক্ত ব্যাক্তি চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন।
কখন ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হলে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হবেনঃ
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ধারা ৩৯ এর উপধারা ১ এ বলা আছে “কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের প্রস্তাব বা বিভাগীয় কার্যধারা রজু করা হইলে , সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অভিযোগের মাত্রা ও প্রকৃতি ,
অভিযুক্ত কর্মচারীকে তাহার দায়িত্ব হইতে বিরত রাখিবার আবশ্যকতা , তৎকর্তৃক তদন্ত কার্যে প্রভাব বিস্তারের আশংকা , ইত্যাদি বিবেচনা করিয়া তাহাকে সাময়িক বরখাস্ত করিতে পারিবে”
অর্থাৎ কারো বিরুদ্ধে যদি বিভাগীয় কোনো কার্যধারা গ্রহন করার শুধুমাত্র প্রস্তাব করা হয় অথবা কোনো কার্যধারা দায়ের করা হয় তাহলে সরকার বা তাকে যে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়েছে সেই কতৃপক্ষ সেই সরকারি কর্মচারিকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে।
কোন শিশু কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে সেও কি সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হবে?
আমরা সকলেই হয়তো এই বিষয়টি অবগত যে কোন ব্যক্তি যদি কোন ফৌজদারি অপরাধে দন্ডিত হয় অর্থাৎ কোন ক্রিমিনাল মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয় তাহলে সাধারণত সরকারি চাকরি নামক যে সোনার হরিণ সেটি হতে সে বঞ্চিত হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন শিশু যদি কোন অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে কি সেই শিশু কোন সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হবে?
এককথায় উত্তর হচ্ছে, না।কোন শিশু কোন অপরাধে দন্ডিত হওয়ার কারনে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে না।
শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪৩(খ) ধারায় বলা আছে “কোন শিশু এই আইন বা অন্য কোন আইনের অধীন কোন অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হইলেও তিনি সরকারি বা বেসরকারি কোন অফিসে চাকরি পাইবার অথবা কোন আইনের অধীন কোন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন না।”
সুতরাং এই ধারা অনুযায়ী বলা যায় ১৮ বছরের কম বয়স্ক কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন অথবা অন্য কোনো আইনের অধীন কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেও সরকারি বা বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সে অযোগ্য হবে না।
বরখাস্তকৃত কর্মচারি কি পরবর্তীতে আবারো নিয়োগ পাবে?
আমরা ৪২ ধারার উপধারা ১ এ জানলাম কোনো ব্যাক্তি মৃত্যুদণ্ড বা এক বছর মেয়াদের অধিক মেয়াদে দণ্ডিত হলে সে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হবেন। এখন প্রশ্ন হলো তার শাস্তি শেষ হওয়ার পর কি সে আবার সেই চাকরিতে যোগ দিতে পারবে? উত্তর হচ্ছে না।
সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ধারা ৩৮ এ বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্রের কর্ম হইতে বরখাস্ত হইয়াছেন এইরূপ কোনো ব্যক্তি ভবিষ্যতে প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্ম বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না”
এ ধারা থেকে বোঝা যাচ্ছে কেও একবার যদি বরখাস্ত হয় তাহলে সে আর অন্য কোনো সরকারি কতৃপক্ষের বিভাগেও নিয়োগ হওয়ার যোগ্য হবে না।
তবে এই আইনেরই ৪২ ধারার ৫(ক) উপধারায় বলা আছে কেও যদি আপিল আদালত কর্তৃক খালাসপ্রাপ্ত হয় তাহলে তাকে সেই চাকরিতেই পুনর্বহাল করতে হবে।
এবং উপধারা ৬ এ বলা আছে খালাসপ্রাপ্ত হওয়ার পর যদি তার চাকরির বয়স শেষ হয়ে যায় অথবা তার চাকরি বিলুপ্ত হয় তাহলে সে সরকার কর্তৃক আর্থিক সুবিধা প্রাপ্ত হবে।
নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কি কি দণ্ড দিতে পারে?
সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় কার্যধারায় দোষীসাব্যস্ত কোন সরকারি চাকরিজীবীকে নিম্নোক্ত এক বা একাধিক লঘু বা গুরুদণ্ড দিতে পারেনঃ
(ক) লঘু দণ্ডসমূহ –
(অ) তিরস্কার;
(আ) নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ;
(ই) বেতন স্কেলের নিম্ন ধাপে অবনমিতকরণ;
(ঈ) কোনো আইন বা সরকারি আদেশ অমান্য করণ অথবা কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত অবহেলার
কারণে সরকারি অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতি সংঘটিত হইলে যথোপযুক্ত ক্ষতি পূরণ আদায়।
(খ) গুরুদণ্ডসমূহ-
(অ) নিম্ন পদ বা নিম্নতর বেতন স্কেলে অবনমিতকরণ;
(আ) বাধ্যতা মূলক অবসরপ্রদান
(ই) চাকরি হইতে অপসারণ;
(ঈ) চাকরি হইতে বরখাস্ত।
লেখকঃ
মোঃ মনিরুজ্জামান
শিক্ষানবিশ আইনজীবী
জামালপুর জজ কোর্ট
Discussion about this post