বিষাক্ত প্যারাসিটামল সেবনে শিশুমৃত্যু নিয়ে মামলায় তদন্তে গাফিলতির কারণে রিড ফার্মার মালিকসহ সব আসামি খালাস পেয়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সঠিক তথ্যপ্রমাণের অভাবে আদালত আসামিদের খালাস দিয়েছেন। আদালতে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার দাখিল করা প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওই কর্মকর্তা সঠিক নিয়ম মেনে জব্দ করা ওষুধের তালিকা ও পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেননি।
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, রিড ফার্মার প্যারাসিটামলে বিষাক্ত ডাই ইথিলিন গ্গ্নাইকলের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। সোমবার দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তার ‘অযোগ্যতা ও অদক্ষতা’র কারণে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এবং ওই প্যারাসিটামল সিরাপে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি শনাক্তকারী ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হানিফ। গতকাল তারা দু’জনেই এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের অভিযোগ, গোঁজামিল ও সঠিক তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন না করে তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের খালাস পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বিষয়টি আরও তদন্তের পাশাপাশি উচ্চ আদালতে সরকারকে আপিল করার পরামর্শ দেন তারা।
এদিকে, বিষাক্ত প্যারাসিটামল সেবনে শিশুমৃত্যুর অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সব আসামির খালাস পাওয়ার পেছনে কারও গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
২০০৯ সালের জুন থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত রিড ফার্মার বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কিডনি নষ্ট হয়ে সারাদেশে ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়। ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হানিফ বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। রিড ফার্মার প্যারাসিটামল সিরাপে বিষাক্ত ডাই ইথিলিন গ্লাইকল ছিল বলে অভিযোগ করেন ওই চিকিৎসক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২২ জুলাই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর রিড ফার্মার কারখানা সিলগালা করে। ওই বছরের ১০ আগস্ট ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম রিড ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পাঁচজনকে আসামি করে ঢাকার ড্রাগ আদালতে মামলা করেন। আদালত ওই দিনই তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ওই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রিড ফার্মার বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা হয়। আসামিদের মধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনজন পলাতক। গত সোমবার আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ গণমাধ্যমকে বলেন, এ ঘটনায় শুধু আমাকে ছোট করা হয়নি, পুরো জাতিকে ছোট করা হয়েছে। প্রমাণিত একটি সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করা হয়েছে, জাতি হিসেবে তা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের।
প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে শিশুমৃত্যু নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘মারা যাওয়া শিশুদের বেশিরভাগই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সিলেট থেকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তাদের সবার উপসর্গও ছিল অভিন্ন। প্রতিটি শিশুর কিডনি বিকল হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় শিশুদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আগে সেবন করা ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করি। ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করে ওই সিরাপে ডাই ইথিলিন গ্লাইকলের উপস্থিতি নিশ্চিত হই। বিষয়টি প্রথমে শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছিলাম। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের নজরে আনা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাকে ডেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য নিয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয়ে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিড ফার্মার প্যারাসিটামলে বিষাক্ত ডাই ইথিলিন গ্গ্নাইকলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।’ তিনি বলেন, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এরপরও তদন্ত কর্মকর্তা ডাই ইথিলিন গ্গ্নাইকলের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি_ এমন প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে থাকলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে পাঠানো কাগজপত্র থেকে প্রমাণ হয়েছিল, রিড ফার্মার প্যারাসিটামলে বিষাক্ত ডাই ইথিলিন গ্গ্নাইকলের উপস্থিতি ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে রিড ফার্মার কারখানা বন্ধ করাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। এত দিন পর ডাই ইথিলিন গ্গ্নাইকলের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি বলে আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলে তা ভয়ানক অপরাধের শামিল। যারা এ ধরনের অপরাধ করেছে, তদন্ত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। সরকার বিষয়টি কঠোর নজরদারি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডা. রুহুল হক।
মামলায় গাফিলতিতে শাস্তি হবে- স্বাস্থ্যমন্ত্রী: আসামিদের খালাসের রায় হওয়ার পরপরই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সচিবালয়ে জরুরি তলব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গতকাল মঙ্গলবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মামলায় কারও গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো সরকারি কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে মামলা থেকে আসামিরা অব্যাহতি পেয়ে থাকলে, তাকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। কারণ, এর সঙ্গে জনগণের স্বার্থ এবং তাদের জীবনমরণের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনার পাশাপাশি প্রতিবেদনের অনুলিপিও নিয়েছেন। ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, রায়ের কপি পাওয়ার পর তা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এটি নিশ্চিত যে কেউ অপরাধ করেছে। নইলে কীভাবে এতগুলো শিশু মারা গেল? এটা হতে পারে না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
যে কারণে খালাস পেলেন আসামিরা: গত সোমবার ঢাকার ড্রাগ আদালতের রায়ে বলা হয়, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার ‘অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে’ অভিযোগ প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। নিয়মনীতি না মেনে আলামত জব্দ করায় আসামিদের সাজা দেওয়া যায়নি। তদন্তে গাফিলতি ছিল। তাই আসামিদের খালাস দেওয়া হলো। ঢাকার ড্রাগ আদালতের বিচারক এম আতোয়ার রহমান ওই রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার আগে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম সঠিক নিয়ম মেনে জব্দ করা ওষুধের তালিকা ও পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেননি। মামলা দায়েরের সময় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তা না নেওয়ায় তার অযোগ্যতা ও অদক্ষতা প্রমাণিত হয়।
সব আসামি খালাসের বিষয়ে জানতে চাইলে ড্রাগ আদালতের পিপি নাদিম মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা রায়ের আংশিক শুনেছি, পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে ঔষধ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে আপিল করার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
সাত বছর আগে করা মামলায় বলা হয়, রিড ফার্মার তৈরি করা প্যারাসিটামলে বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। বিষাক্ত উপাদানের কারণে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। রিড ফার্মার এমডি মিজানুর রহমান ওই বছরের ১২ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করলে ঢাকার বিচারিক আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তার স্ত্রী কোম্পানির পরিচালক শিউলি রহমান হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। অন্য তিন আসামি পলাতক।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিনকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিষাক্ত উপাদান থাকার বিষয়টি ধরা পড়ার পরও সব আসামি খালাস পাওয়ার ঘটনা দুঃখজনক। এতে অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
দুই যুগে ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে সহস্রাধিক শিশুর মৃত্যু: সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কিডনি অকেজো হয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। তৎকালীন আইপিজিএমআর হাসপাতালের একজন চিকিৎসক ১৯৮৬ সালে ছয় শতাধিক শিশুর কিডনি ডায়ালিসিস করেন। এসব শিশুর বেশিরভাগই মারা যায়। এ ছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতালেও পাঁচ শতাধিক শিশুর মৃত্যু হয়। তাদের কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। শিশুমৃত্যুর ঘটনায় প্যারাসিটামল সিরাপ নিয়ে অভিযোগ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত অ্যাডফ্লেম কারখানা এবং ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে প্যারাসিটামলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু দেশের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবে পরীক্ষার পর্যাপ্ত সুবিধা ছিল না। এ কারণে ভারত থেকে একজন বিশেষজ্ঞ এনে এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানির (ইডিসিএল) ল্যাবে ওই ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে বিষাক্ত ডাই ইথিলিন গ্গ্নাইকলের উপস্থিতি ধরা পড়ে। ১৯৯৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডা. আনোয়ার পাশা এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওই মামলায় প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপকসহ তিনজনের ১০ বছর কারাদণ্ড দেন এই আদালত। একই আদালত ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে ১৯৯২ সালে ৭৬ শিশুমৃত্যুর ঘটনায় ড্রাগ আইনে করা আরেকটি মামলায় বিসিআই ফার্মার ছয় কর্মকর্তাকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আ ব ম ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ ধরনের তদন্তে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিষয়টি কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা হতে পারে। আবার জেনেশুনে কোনো কিছুর বিনিময়ে তারা এ কাজ করে থাকতে পারে। তাদের কারণে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, এটা অন্যায়। সরকারের প্রতি এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। সূত্র: রাজবংশী রায়/সমকাল
Discussion about this post