বিশ্বের সর্বত্র প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তাদের চলার গতি থমকে যাচ্ছে কজলিস্টে (মামলার প্রতিদিনের কার্যতালিকা) মান্ধাতার পদ্ধতি ব্যবহার করায়। যদিও গুরুত্বপূর্ণ মামলার নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেলেও কার্যত তা আলোর মুখ দেখছে না। ফলে গত এক বছরেও বন্ধ হয়নি কাগজে ছাপানো কজলিস্ট।
জানা গেছে, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কজলিস্ট সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। এরপরও তা ছাপানো হয় কাগজে। অর্থাৎ অনলাইন এবং কাগজে ছাপানো কজলিস্ট তৈরি সমানতালে চলছে। মূলত সে কারণেই যে উদ্দেশ্য নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ অনলাইন কজলিস্ট চালু করতে চেয়েছিল, তা কার্যত আলোর মুখ দেখেনি।
সুপ্রিম কোর্টে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েও পুরোপুরি সাফল্য অর্জন করার গৌরব অর্জন করতে পারেনি আদালত প্রশাসন। তারা বলছেন, আইনজীবীদের চরম আপত্তির মুখে অনলাইনে মামলার দৈনন্দিন তালিকা (কজলিস্ট) পুরোপুরি চালু থাকলেও তার সঙ্গে কাগজে ছাপানো হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সময় এবং টাকা খরচ কমানোর জন্য দেশের ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইন কজলিস্ট চালু করায় কাগজে ছাপানো কজলিস্ট তৈরির কাজ বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
এদিকে আপিল বিভাগের দৈনন্দিন মামলার কার্যতালিকা ও মামলার সর্বশেষ তথ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হলেও সেটিও কার্যকর রূপ নিতে পারেনি। অনলাইনে আপিল ও হাইকোর্ট উভয় বিভাগের মামলার সিদ্ধান্ত এবং রায় প্রকাশ করার পরও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে অনীহা রয়েছে অনেক আইনজীবীর।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি রাতে অনলাইনে আপলোডের পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অনলাইন কজলিস্ট চালু করে কাগজে ছাপানো কজলিস্ট বন্ধ করে দেয়ার কথা ছিল। সেই পরিকল্পনার আজও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
অনলাইনে কার্যতালিকা থেকে বিচারপ্রার্থীরা দেশের যেকোনো প্রান্ত বসে মামলার সর্বশেষ তথ্য জানতে পারবেন। এতে বিচারপ্রার্থীদের অর্থ ও সময়ের সাশ্রয় হয়। এছাড়া বিচারপ্রার্থীদের নিজ মামলার শুনানির বিষয় প্রয়োজন মতো ওয়বেসাইট থেকে প্রিন্ট করেও নিতে পারবেন। কোন মামলা কি অবস্থায় আছে, তার তথ্যও কার্যতালিকায় দেখা যাবে। এতে আইনজীবী, সহকারী ও সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎকোচ নেয়া বন্ধ হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আইনজীবী জানান, উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু কজলিস্টের সঙ্গে যে ‘সার্চিং লিস্ট’ পেতাম সেটার কি হবে? এছাড়া সব আইনজীবীর তো ইন্টারনেট দক্ষতা নেই। ফলে মামলা ‘মিস’ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক এবং বর্তমান নেতারা গণমাধ্যমকে জানান, আদালতের মামলার কার্যতালিকা দেখেন আইনজীবীদের সহকারীরা। তারা ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ নন। তাই কজলিস্ট অনলাইনে প্রকাশ হলে তারা তা বুঝতে পারবেন না।
তবে এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, এ বিষয়ে আইনজীবীদের অভিজ্ঞতার জন্য প্রধান বিচারপতি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
আইনজীবীদের আপত্তির বিষয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ বলেন, আইনজীবীদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা ওয়েবসাইট থেকে যে কোনো সময় কার্যতালিকা প্রিন্ট করা যাবে। আইনজীবীদের সহায়তার জন্য ‘সাপোর্ট সেন্টার’ রয়েছে। খুব জরুরি হলে এক্ষেত্রে হয়তো কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করে কিছু কপি দেব। এরপরও বিশেষ করে সিনিয়র আইনজীবীদের চরম বিরোধিতার মুখে অনলাইন কজলিস্ট এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম জানান, ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুধু অনলাইনে আপলোডের সিদ্ধান্ত জানানো হলেও আইনজীবীদের আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে প্রতিটি কজলিস্ট ছাপাতে প্রায় ৪০০ টাকা খরচ পড়ে, এতে বছরে মোট খরচ হয় প্রায় ২১ কোটি টাকা। অথচ গ্রাহক চাঁদা বাবদ বছরে আয় হয় মাত্র ৬০-৭০ লাখ টাকা। বাকি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়।
তিনি বলেন, পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থা চালু হলে সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। এছাড়া আমরা চাই আদালতের কার্য প্রক্রিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মামলার জট কমাতে, যেন জনগণের কষ্ট লাঘব হয়।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, আপিল বিভাগে দুটি এবং হাইকোর্টে অর্ধশত বেঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে দ্বৈত ও একক বেঞ্চও রয়েছে। প্রতিটি বেঞ্চের প্রতিদিনের মামলার কার্যতালিকা হয় কয়েকশ পৃষ্ঠার। আর আপিল বিভাগের কার্যতালিকা হয় ৭-৮ পৃষ্ঠার।
সুপ্রিম কোর্টের প্রতিদিনের জন্য একটি কজলিস্ট ছাপতে খরচ হয় ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। ছাপা হয় প্রায় দুই হাজার ৬০০টি। কিন্তু এটির গুরুত্ব দিনের আলো পর্যন্তই থাকে। দিন শেষে নতুন কজলিস্ট ছাপার কার্যক্রম শুরু হয়। আর প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার কাগজের নথিগুলো একসময় কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।
এছাড়া আগের দিন রাতের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কোর্টের বেঞ্চ অফিসাররা পরদিন কার্যতালিকার খসড়া পাঠান বেঞ্চ ও ডিক্রি শাখায়। রাত ৮টার মধ্যে তা পাঠানো হয় বিজি প্রেসে। সেখানে বেতন এবং ওভারটাইম হিসাব বাদ দিয়েই বছর শেষে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। কিন্তু আইনজীবীদের কাছ থেকে এ বাবদ প্রতি বছর চাঁদা আদায় হয় মাত্র দুই হাজার ৫০০ টাকা। ফলে সরকারকে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়।
এদিকে অনলাইন কার্যতালিকা মনিটরের জন্য প্রধান বিচারপতি ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার (জেলা জজ) বেগম হোসনে আরা আক্তারের নেতৃত্বে মনিটরিং কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার এস এম এরশাদুল আলম, ডেপুটি রেজিস্ট্রার আজিজুল হক, গবেষণা ও তথ্য কর্মকর্তা শামীম সুফী এবং বেঞ্চ ও ডিক্রি শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার বেগম মহোনাজ সিদ্দিকী।
ওয়েবসাইটটি সব সময় সচল রাখতে ব্যাকআপ সার্ভার এবং সাবমেরিন ক্যাবল কেটে গেলেও অনলাইন কজলিস্ট যাতে ইনপুট দেয়া যায় এজন্য স্যাটেলাইট বেজড ইন্টারনেট কানেকশনের ব্যাকআপ রাখাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এছাড়া আইসিটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল হার্ডওয়্যার সাপোর্ট দিতে এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এ টু আই প্রজেক্ট থেকে সফটওয়্যার সাপোর্টের জন্য একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছিল। তবে এখন সবই ভেস্তে যাচ্ছে।
ফজলুল হক/জাগো নিউজ
Discussion about this post